Saturday 29 March 2014

আমার পাড়াতুতো কৈশোর

আমার বন্ধুবান্ধবদের তুলনায় আমার কৈশোরটা এক্কেবারে আলাদা ছিল। বিশেষত সেন্ট থমাস' বা সেন্ট জেভিয়ারসের বন্ধুদের তুলনায়। মফঃস্বলে বড় হয়েছি বলে। এটা আমার একটা একান্তই অহংকারের জায়গা।

পুরো কৈশোর নিয়ে গুছিয়ে লিখতে সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতা এবং ধৈর্য দরকার, যে দুটোর কোনটাই আমার নেই, এবং সেই বিষয়ে কোন সন্দেহও আমার নেই। তাই ভাবছি টুকরো টুকরো করে, মানে বুলেট পয়েন্টস করে ব্যাপারটা ধরার চেষ্টা করব। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও, ইত্যাদি...

যাই হোক! লিস্টে আসা যাক।



- আমাদের পাশাপাশি সব কটা বাড়িতেই বেশ ক'টা করে পেয়ারা গাছ, নারকোল গাছ এবং সুপুরি গাছ ছিল। ইন ফ্যাক্ট, এটা বলার মতো কোন বিষয়ই নয়। এই বেসিক গাছগুলো ছাড়া কার বাড়িতে কি কি গাছ ছিল তাই নিয়ে বরং আলোচনা হলেও হতে পারে। যেমন, আমাদের বাড়িতে আম গাছ এবং বাতাবি লেবু গাছ ছিল। আমাদের পেছনের বাড়িতে জামরুল। পাশের বাড়িতে (যেটাকে আমি অনেকদিন অবধি নিজেরই আরেকটা বাড়ি বলে জানতাম। সেটার জন্য একটা আলাদা ডেডিকেটেড পোস্ট লাগবে।) গন্ধরাজ লেবু, পাতাবাহারি ইত্যাদি বেশ কিছু শৌখিন গাছ ছিল। তার পাশের বাড়িতে, কাঁঠাল। এবং আমাদের সামনের বাড়িতে, খেজুর।

- যেদিন লোক ডেকে নারকেল পাড়ানো হতো, আমরা ভাইবোনেরা সবাই গাছের নীচে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে ওপরদিকে তাকিয়ে সেই কাটারি হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে নারকেল গাছে চড়া, তিন-চারটে নারকেল একসাথে বেঁধে দড়ি দিয়ে নামান, ইত্যাদি ম্যাজিকাল ব্যাপার-স্যাপার পরম বিস্ময়ে মুখ হাঁ করে দেখতাম। এই কাণ্ডটির পর বেশ কয়েক সপ্তাহ অবধি আমাদের খাটের নীচে কচি ডাব থেকে ঝুনো নারকোল ভরে থাকত, আর নিজেরা খেয়ে শেষ করা যেতো না বলে লোকজনকে ডেকে ডেকে সেগুলো বিলোনো হত।

- আমরা চিরকাল গাছে চড়ে বা অন্তত আঁকশি দিয়ে পেড়ে পেয়ারা খেয়েছি। পেয়ারা যে বাজারে পাওয়া যেতে পারে অনেদিন অবধি ধারণাই ছিলনা। দুঃখের বিষয় হল, আমি পেয়ারা ভালবাসা সত্ত্বেও আজও বাজার থেকে কেনা পেয়ারা খেতে পারিনা। চেষ্টা করেছি অনেকবার, জাস্ট পারিনি।

- আমরা পেয়ারা পাঁচিলে বসে খেতাম। পেয়ারা পাঁচিলে বসেই খেতে হয়।

- আমি হাতে সর্ষের তেল মেখে দিব্যি কাঁঠাল ভাঙতে পারি।

- আমাদের বাড়ির ২০০ মিটার রেডিয়াসের মধ্যে যে বাড়িতেই কাঁঠাল ভাঙ্গা হোক, বিকেলে অন্তত এক টিফিন বক্স ভর্তি ওই স্বর্গীয় বস্তুটি আমার নাম করে বাড়িতে পৌঁছে যেত।

- সিজন বেসিসে রেগুলার কোন না কোন বাড়িতে কাঁচা আম উইথ কাসুন্দি, কদবেল, ইত্যাদি মাখা এবং পাড়াময় বিতরণ করা হতো।

- পাশের বাড়িতে দিদা, এখন আর পারেন না, কিন্তু ক'বছর আগে অবধিও নারকোল গাছের পাতা পড়লে একটা বঁটি নিয়ে বসে যেত আঁশ ছাড়াতে। ঝাঁটা যে দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, এবং বেশ শস্তাতেই পাওয়া যায়, দিদা বোধ হয় কোনোদিন জানত না।

- বলাই বাহুল্য, তুলসি মঞ্চ, বাগান, এসবের জন্য আলাদা ডেসিগ্নেটেড জায়গা সব বাড়িতেই ছিল। টিউবওয়েলও। ওই নারকোল, সুপুরি বা পেয়ারা গাছের মতই এটা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। উপরন্তু যা ছিল আর মনে পড়ছে, ক'টা বলি। যেমন, আমাদের পাশের বাড়িতে (অর্থাৎ, যেটা আমার আরেকটা নিজের বাড়ি, সেটায়) কুয়ো আছে, কালীপূজোর জন্য বেশ বড়সড় একটা মঞ্চ আছে, ইত্যাদি। সামনের বাড়িতে একটা বেশ দীঘি আর পুকুরের মাঝামাঝি সাইজের ওয়াটার-বডি ছিল, যেটার পরিচয় এখন জি প্লাস ফোর ফ্ল্যাট উইথ লিফট। পাশের গলিতে আরেকটা বাড়িতে গোয়াল ছিল। আমরা এড়িয়েই চলতাম। শুধু দোলের দিন গোবর জলে মিশিয়ে শত্রুপক্ষকে স্নান করানো ছাড়া ওই গোয়ালের আর কোন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আমাদের জীবনে ছিল না। (এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল - আমাদের জমিতেও বাড়ির বাঁদিকে বেশ বড়সড় একটা বাঁধানো জায়গা ছিল, তাতে দু'তিনটে ঘর বানানো ছিল, কিন্তু সেই জায়গাটা লুকোচুরি খেলা ছাড়া অন্য কোন কাজে আসতে কখনও দেখিনি। অ্যাপার্ট ফ্রম বিয়েবাড়ি।)

-  লোডশেডিং প্রায়ই হতো। লোডশেডিং হলে আমরা লুডো খেলতাম, খুব চোট্টামি করতাম, আর পাশাপাশি মশা মেরে প্রত্যেকে একটা করে ছোট্ট মশার ঢিপি বানাতাম। আমি প্রথমটায় জিততাম, দ্বিতীয়টায় সবসময় হারতাম। দিদা চোখে দেখত না, মাঝেমাঝে নিজের দানে আমার গুঁটি চেলে দিলে আমি অবশ্যই কিছু উচ্চবাচ্য করতাম না।

- বিকেলবেলা মশা হলে আশেপাশের বাড়িতে ধুনো দেওয়া হতো। (আমাদের বাড়িতে অবশ্য হতনা। আমার মায়ের জন্ম, বড় হওয়া, প্রাক-বিবাহ জীবন পুরোটাই সাউথ কলকাতায় কাটায় মা এসব মফস্বলি ব্যাপারে চিরকালই বেশ আনাড়ি।)

- বিকেল থেকে সন্ধ্যে হওয়াটা কোনোদিন ঘড়ি দেখে জানতে হতনা। চারিদিকে সব বাড়ি থেকে দু-এক মিনিটের ব্যবধানে শঙ্খ বাজত। সময়মত দৌড়ে গেলে নকুলদানা বা বাতাসা পাওয়া যেতো অপর্যাপ্ত। (এই ব্যাপারটাও আমাদের বাড়িতে মিসিং ছিল, কারণ আমাদের বাড়ি ছিল ঘোরতর নাস্তিক। ভাগ্যিশ!)

(আমাদের বাড়িতে এই হতনা - সেই হতনা যতই খেয়াল করছি ততই মনে হচ্ছে, তাহলে আমাদের বাড়িতে হতটা কি? মানে, আমাদের বাড়িটাও তো বেশ পপুলার ছিল; রহস্যটা কি? তারপর মনে পড়ল। আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর আগ দিয়ে ঋতুরঙ্গের স্ক্রিপ্ট লেখা হতো, নাচ-গান-আবৃত্তির রিহার্সাল হত, ফি রবিবার বিকেল চারটেয় উত্তম-সুচিত্রাকে গোগ্রাসে গেলা হতো (আমাদের বাড়িতেই বোধ হয় প্রথম টিভি এসেছিল), আর সর্বোপরি, পাড়ার ইয়ং পিসি-কাকাদের বিশেষ বন্ধুদের ফোন করে "পাঁচ মিনিট পর আবার করব, একটু ডেকে দেবেন?" হত।)

- আমরা পাড়ার বাচ্চা-কাচ্চারা মিলে ফি বছর প্রায় প্রতি গরমের ছুটিতেই নতুন করে একটা ক্লাব এবং একটা লাইব্রেরি চালু করতাম। পাড়ার মা-কাকিমাদের থেকে মেম্বারশিপ ফি বাবদ খুচরো পয়সা নিতাম এবং রসিদ কেটে দিতাম। রসিদের নীচে সইটা অবশ্যই প্রতিবছর হাতের লেখার উন্নতি বা অবনতির সাথে সাথে বদলাত। ক্লাবের নামকরণ নিয়ে দু'রাত্তির ঘুম হতনা। অবশ্যই, প্রত্যেকবছর নতুন করে উদ্যম এবং নতুন করে নামকরণ করা হতো।

লিখতে লিখতে রিয়ালাইজ করছি, এই লিস্টের কোন শেষ নেই। তবু, কোথাও তো একটা থামতে হবে। তাই এই পয়েন্টটা দিয়েই শেষ করি -

- আমাদের বাড়ির গলিতে চারটে বাড়ি। এই চারটে বাড়ি একে অপরের নিকটাত্মীয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয়না। এই আমাদের ইমিডিয়েট পাড়া। তা, এই পাড়ার যে কোন বিয়েতেই এই চারটে বাড়ির দায়িত্ব যেভাবে ভাগাভাগি করা থাকত যে বাইরের কারোর পক্ষে নেমন্তন্নর কার্ড না দেখে গেস করা সহজ হতনা যে বিয়েটা এর মধ্যে কোন বাড়ির ছেলের বা মেয়ের। আমাদের বাড়ির দোতলায় মেয়ে বসত, আর নিচের তলায় অতিথিদের জন্য সারি দিয়ে চেয়ার। আর ওই পিছনের বাঁধানো জায়গাটা, যেখানে লুকোচুরি খেলা ছাড়া আর কিছু হতনা আদারওয়াইজ, সেখানে বড় বড় উনোন বসিয়ে রাঁধুনি দিয়ে রান্না হতো। আমার অন্য বাড়িটায়, ওই নিচের ঘরটায়, মেঝেতে ফরাস পেতে বর বসানো হতো। আর দুটো বাড়ি মেইনলি গেস্ট হাউজ হিসেবে ব্যবহার হতো (শুনতে সেকেন্ডারি লাগলেও ওই দায়িত্বটাই সব চেয়ে কঠিন এবং লম্বা, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই!)। আর গলির মুখেই বড় করে গেট এবং সেখান থেকে চতুর্থ বাড়িটা অবধি টানা প্যান্ডেল হতো। লাইন করে বেঞ্চ-চেয়ার পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা ওখানে।

বলাই বাহুল্য, এখন আর রামও নেই আর অযোধ্যাও নেই। আমার বিয়ে আর আমার ভাইয়ের বউভাত দুটোই হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হল ভাড়া করে হয়েছে।

সবার বয়েস ও হয়েছে। সবার বাড়িতেই আমাদের জেনেরেসানের সবাই প্রবাসী। পাড়ার অ্যাভারেজ এজ বোধহয় পঞ্চাশোত্তির্ণ হবে। এখন আর কেউ ফি সন্ধ্যে বেলা একসাথে বসে সিরিয়াল দেখতে দেখতে চা-মুড়িভাজা খায় না। কারোর বাড়িতেই আর অত গাছ নেই, টিউবওয়েল নেই, মায় খালি জমিও আর নেই; সব বাড়ি এক্সটেন্ড হয়ে পুরো জমি নিয়ে নিয়েছে। নারকোল ঝুনো হয়ে নিজে থেকেই গাছ থেকে পড়ে এককোণে পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। নারকোল পাতা পড়লে মিউনিসিপালিটির ময়লার গাড়িকে এক্সট্রা পয়সা দিয়ে ব্যবস্থা করা হয়। কালবৈশাখীর পরের দিন "ইশ! সব আমের মুকুল ঝরে গেল!" সুলভ দুঃখ আজকাল আর কারোর হয়না। এবারে বাড়ি গিয়ে কাছেই একটা মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখলাম, তারপর বিগবাজারে শপিং।

এখন আমরা বেশ কলকাতা-কলকাতা ফিল করি। হোয়াটেভার দ্যাট মিনস!


2 comments:

  1. Aro bujhi kichu golpo chilo, tobe segulo golpo ba ghotona, thik paratuto hoito noi. Abritti kora? Pasher barir Kali pujo - poreo office theke chhuti newa Kali pujor timey, Durga Pujor samaye noi? Aar Bittu jokhon chhoto chilo tokhon ekbar oke chhad theke feley debar prochesta, out of envy?

    ReplyDelete
  2. Kalipujo nie alada blogpost hobe. Ar Bittuke nie blogpost hobena.

    ReplyDelete

Did you like it? Did you not? Please leave a comment...