পরমার জীবনে আজ নিঃসন্দেহে একটা স্পেশাল দিন।
মিমি ফোন করেছিল, কনভোকেশান সবেমাত্র শেষ হল। তারপরেই আদিত্যর ফোন - "রমা, মেয়ে ডক্টরেট হয়ে গেল, ভাবতে পারছো?" গর্বিত পিতার উত্তেজনা আর আনন্দে মাখামাখি গলায় বলছিল আদিত্য - "কি খাবে বল আজকে, চাইনিজ? ট্যাংরা যাবে?" তারপর আর আবেগটা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল - "সব তোমার জন্য, রমা! ভাবো তো, তুমি কিভাবে ছুটেছ মেয়েকে নিয়ে, টিউশন থেকে সাঁতারের ক্লাব থেকে গানের স্কুল। নিজের কাজ সামলে মেয়েকে সামলে সংসার সামলে... সব ক্রেডিট তোমার! কি যে আনন্দ হচ্ছে আজকে..." আদিত্যর গলাটা ধরে এসেছিল!
পরমাও ভীষণ শান্তিতে, আনন্দে, গর্বে ভেসে যাচ্ছিল সে মুহূর্তে - "সব সার্থক, তাই না আদিত্য?"
- "হ্যাঁ। সত্যিই সার্থক! যাই হোক, শোন। আমার একটা মিটিং আছে, ফিরতে ফিরতে আটটা হবে। তুমি রেডি হয়ে থেকো, কোথাও খেতে যাবো চল।"
- "ঠিক আছে। ভালোই হল, আমারও কটা খাতা দেখা বাকি আছে, মিটিয়ে নিয়ে একবারেই বেরবো। ও হ্যাঁ, তুমি শুভর বাড়িতে ফোন করেছিলে?"
- "করেছিলাম। শুভর বাবা ধরেছিলেন। খুশিই তো মনে হল। তবে ওই, ওনাদেরকে জানোই তো। বললেন, যাক বউমা এবার একটু ঘরসংসারের দিকে মন দিতে পারবে। এতদিন তো শুধু ইউনিভারসিটি, ল্যাব, সেমিনার, লাইব্রেরি নিয়েই ছুটোছুটি করছিল। এইসব আর কি..."
- "তুমি বললে, মিমি চাকরি জয়েন করবে সামনের মাসে?"
- "না, বলিনি। ছাড়ো না ওসব, আজকের দিনে। শুভ নিজেই ওর বাবা-মা কে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলবে 'খন। ওদের ব্যাপার ওদেরকেই বুঝে নিতে দাও, আমাদের এসব ব্যাপারে মাথা না গলানোই ভালো।"
- "তা ঠিক!" ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল পরমা।
xxxxxx
খাতার গোছাটা নিয়ে বসতে গিয়েও হঠাৎ কি মনে হওয়ায় এক-পা এক-পা করে বইয়ের আলমারিটার দিকে এগোল পরমা। ওই তো, ডানদিক থেকে তিন নম্বর। গীতবিতানটা টেনে বার করতে গিয়েই নজরে পড়ল সেই পুরনো বাঁধানো ডাইরিটা। পরমার সেই স্কুললাইফ থেকে ডাইরি লেখার অভ্যাস, এবং আশ্চর্যভাবে এই দীর্ঘকালের অসংখ্য বাসা-বদল, শহর-বদল পেরিয়েও এই ডাইরিটা কেমন করে জানি থেকে গেছে। ডাইরিটা হাতে নিয়ে পাতা ওলটাল পরমা।
প্রথম পাতাতে ক্লাস সেভেনের কিছু তুচ্ছ হৃদয়-ভঙ্গের কথা, পড়ে হাসি পেল আজকের পরমার। পাতা উল্টোতে উল্টোতে স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজ জীবন, আকাশের সাথে ছাড়াছাড়ি, আদিত্যর সাথে দেখা, বাবা-মা কে বলা - সব ধরা আছে এই মলিন খয়েরি দুটো মলাটের মাঝখানে। কি আশ্চর্য, না?
তারপর, তিন দশক প্রায়, কিছুই লেখেনি কখনও। আবার এতগুলো বছরের তফাতে গত বছর থেকে আবার নতুন করে ডাইরি লেখা শুরু। শেষের কয়েক পাতা নেহাতই এখনকার জীবন - হেডমিস্ট্রেস হিসেবে স্কুলে প্রোমোশন, আদিত্যর চাকরি বদল, মিমির বিবাহোত্তীর্ণ নতুন জীবনের টুকরো-টুকরো ঘটনা, চারিদিকের ছোটবড় নানা খবর এবং তা নিয়ে পরমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, প্রতিক্রিয়া, আরও নানা তুচ্ছ বিষাদ, অভিমান, ইত্যাদি। শেষ এন্ট্রিটা দেখে প্রথমে মজাই লাগলো পরমার - সচিন তেন্ডুলকরের রিটায়ারমেন্টের দিন লেখা। মনে পড়ল, ওইদিন আদিত্য পরমা দুজনেই সারাদিন টিভির সামনে থেকে নড়তে পারেনি, স্নান-খাওয়া মাথায় উঠেছিল। আর শেষে সচিনের ওই বাইশ-গজের পিচকে ছুঁয়ে বুকে হাত ঠেকানোটা দেখে আদিত্য অস্ফুটে বলে উঠেছিল - "সত্যিই, রিটায়ার করতে জানতে হয়!"
খানিকটা থমকে গিয়ে লেখাটার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পরমা। সত্যিই তো!
xxxxx
আবার ফোন। আদিত্য।
- আচ্ছা শোন, তুমি পারলে একটু মিষ্টি-টিষ্টি এনে রাখো। এতো ভালো একটা খবর, বাড়িতে কেউ এলে একটু মিষ্টিমুখ তো করাতে হবে।
- "সত্যি, তুমি এতো এক্সাইটেড আদিত্য।" হেসে ফেলল পরমা। "কেই বা আর আসছে বলো এখন? আজকাল কি আর কেউ আগেকার দিনের মতো না বলে আসে?"
তবু কি ভেবে ফোনটা রেখে পরমা বেরিয়েই পড়ল।
পুরনো পাড়া, বহুদিনের চেনা দোকান। দোকানদার একগাল হেসে বলল - "প-ঞ্চা-শ-টা রসগোল্লা! আপনার আর দাদার দুজনেরই তো সুগার, তাই না বউদি?"
পরমার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি তখন। কি যে ভাবছে নিজেও ঠিক তলিয়ে বুঝে উঠতে পারছে না। আনমনে উত্তর দিলঃ
- "নাহ, বলা তো যায় না, কখন লোকজন এসে যায়!"
xxxxx
বাড়িতে ফিরে ঘড়ির দিকে তাকালো পরমা। ইশ, দেখতে দেখতে চারটে বেজে গেল! আদিত্য আসবে আটটায়, মানে মাঝখানে আর চারটে ঘণ্টা মাত্র।
স্কুলের ঝোলাব্যাগটা টেনে নিয়ে স্টাডিতে এলো পরমা। খাতাগুলো প্রায় হয়েই এসেছিল, আর মোটে খান কুড়ি বাকি। ঝটপট বাকি খাতাগুলো দেখে নিয়ে যত্ন করে পরমা নম্বরগুলো টুকে রাখল গোলাপি রেজিস্টারে। তারপর একটা কাগজের টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে রেজিস্টারের ওপরের মলাটে আঠা দিয়ে টানটান করে লাগিয়ে টানা হাতের লেখায় একটা নোট লিখে রাখলো - "ক্লাস এইটের রিপোর্টকার্ড সামনের সপ্তাহে, অঙ্কের নম্বরগুলো কালই স্কুলে পৌঁছে যাওয়া দরকার।" লিখে নিচে সই করে তারিখটা বসিয়ে কাগজপত্র সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরলো পরমা। ঘড়িতে তখন পাঁচটা পঁয়ত্রিশ।
এবারে নিজের শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেওয়াল আলমারি থেকে গোদরেজের চাবিটা নিয়ে পরমা চলে এলো মিমির ঘরে।
মিমির ঘরটা গত পাঁচ বছরে বিশেষ বদলায়নি। মিমি চলে গেছে বিদেশে পড়তে, তারপর বিয়ে-থা। এখন মিমি-শুভ বছরে একবারের বেশি আসতেই পারেনা। তাও বড়জোর দিন সাতেকের জন্য থাকা হয় এই ঘরে, বাকিটা শ্বশুরবাড়ি। যে মিমি মা-কে ছেড়ে এক রাত্তিরও অন্য ঘরে শুতে পারতনা, সে এখন কত্তো স্বাবলম্বী হয়ে গেছে, নিজের মনে ভাবলো পরমা। তারপর এগিয়ে গিয়ে আলমারিটা খুলে শাড়ি বাছতে বসলো।
এইসব শাড়িরও কত নানারকম স্মৃতি! এই ক্রিম-মেরুন আসাম সিল্কটা,এটা মিমির শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রণামীতে দিয়েছিলো। নীল বালুচরিটা একবার আদিত্য নিজে হাতে করে কিনে এনেছিল; পরমা তো অবাক, আদিত্য আবার শাড়ি-টাড়ি চেনে নাকি! এই আসমানি রঙের ঢাকাইটা, এটা মিমি দিয়েছিলো ওর প্রথম স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে। শাড়ীগুলো আনমনে ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘড়ির আওয়াজে হঠাৎ চমক ভাঙল, ইশ, ছ'টা বেজে গেল!
ক্ষিপ্র হাতে শাড়িটা খুঁজে বার করল পরমা। ওর বিয়ের বেনারসি। উল্টেপাল্টে দেখে বুঝল, জরি ফেঁসে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। সে যাক গে! ব্লাউজটা তো গায়ে হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা, তাই তাড়াতাড়ি করে যাহোক ম্যাচিং একটা লাল ব্লাউজ খুঁজে নিল। তারপর তোয়ালে, সাবান সব নিয়ে স্নানঘরে গিয়ে দীর্ঘসময় ধরে স্নান করল সে। মনে মনে একটা আশঙ্কা চলছে যদিও, দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো! তবু অস্থিরতা কাটিয়ে ধীর হাতে শ্যাম্পু করল চুলে, কন্ডিশনার লাগালো। মিমির দেওয়া বিদেশি সুগন্ধি বডি-জেল, যেটা ছ'মাসের ওপর শুধু তুলেই রাখা ছিল, আজ নামালো পরমা। শাওয়ারের দিকে মুখ তুলে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে জলটাকে পুরো শরীর দিয়ে গ্রহন করল, তারপর নিজেকে ভালবেসে, যত্ন করে, আদর করে স্নান করল সে। তারপর বেরিয়ে এসে পরিপাটি করে শাড়িটা পরল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। চুল আঁচড়ে, মাঝখানে সিঁথি করে, চিরুনির ধার দিয়ে মোটা করে সিঁদুর পড়ল সিঁথি জুড়ে। না, কেনা টিপ নয়, তর্জনীতে সিঁদুর নিয়ে সুন্দর করে গোল করে সিঁদুরের টিপ আঁকলো কপালে। দেরাজ খুলে শাঁখা-পলা বার করে পরল; আজকাল এগুলো পুজোপার্বণের জন্যেই তুলে রাখা হয়।
তারপর মিমির আলমারি খুলে একটা ওড়না পছন্দ করল সে। প্রথমে ম্যাজেন্টা রঙের ওড়নাটা পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু পরনের লাল বেনারসিটার সঙ্গে ম্যাচ করে একটা লাল জরিপাড় দেওয়া ওড়না বেছে তুলে নিল পরমা। তারপর শোওয়ার ঘরে খাটের ওপর চেয়ারটা তুলতে গিয়েও হঠাৎ কি মনে হওয়ায় ফিরে গিয়ে সদর দরজার ছিটকিনিটা খুলে রেখে এলো সে। আদিত্য ঢুকবে কি করে, নাহলে?
xxxxx
আদিত্য যখন আটটা পনেরো নাগাদ ঘরে ঢুকল, পরমার শরীরটা তখনও উষ্ণ গরম। পা-দুটো বিছানার থেকে ফিট খানেক ওপরে হালকা দুলছে। হাতের মুঠো আলগা, তার ফাঁকে একটা ছোট্ট চিরকুট -
"ভালো থেকো, আদিত্য। মিমি, ভালো থাকিস মা!"
মিমি ফোন করেছিল, কনভোকেশান সবেমাত্র শেষ হল। তারপরেই আদিত্যর ফোন - "রমা, মেয়ে ডক্টরেট হয়ে গেল, ভাবতে পারছো?" গর্বিত পিতার উত্তেজনা আর আনন্দে মাখামাখি গলায় বলছিল আদিত্য - "কি খাবে বল আজকে, চাইনিজ? ট্যাংরা যাবে?" তারপর আর আবেগটা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল - "সব তোমার জন্য, রমা! ভাবো তো, তুমি কিভাবে ছুটেছ মেয়েকে নিয়ে, টিউশন থেকে সাঁতারের ক্লাব থেকে গানের স্কুল। নিজের কাজ সামলে মেয়েকে সামলে সংসার সামলে... সব ক্রেডিট তোমার! কি যে আনন্দ হচ্ছে আজকে..." আদিত্যর গলাটা ধরে এসেছিল!
পরমাও ভীষণ শান্তিতে, আনন্দে, গর্বে ভেসে যাচ্ছিল সে মুহূর্তে - "সব সার্থক, তাই না আদিত্য?"
- "হ্যাঁ। সত্যিই সার্থক! যাই হোক, শোন। আমার একটা মিটিং আছে, ফিরতে ফিরতে আটটা হবে। তুমি রেডি হয়ে থেকো, কোথাও খেতে যাবো চল।"
- "ঠিক আছে। ভালোই হল, আমারও কটা খাতা দেখা বাকি আছে, মিটিয়ে নিয়ে একবারেই বেরবো। ও হ্যাঁ, তুমি শুভর বাড়িতে ফোন করেছিলে?"
- "করেছিলাম। শুভর বাবা ধরেছিলেন। খুশিই তো মনে হল। তবে ওই, ওনাদেরকে জানোই তো। বললেন, যাক বউমা এবার একটু ঘরসংসারের দিকে মন দিতে পারবে। এতদিন তো শুধু ইউনিভারসিটি, ল্যাব, সেমিনার, লাইব্রেরি নিয়েই ছুটোছুটি করছিল। এইসব আর কি..."
- "তুমি বললে, মিমি চাকরি জয়েন করবে সামনের মাসে?"
- "না, বলিনি। ছাড়ো না ওসব, আজকের দিনে। শুভ নিজেই ওর বাবা-মা কে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলবে 'খন। ওদের ব্যাপার ওদেরকেই বুঝে নিতে দাও, আমাদের এসব ব্যাপারে মাথা না গলানোই ভালো।"
- "তা ঠিক!" ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল পরমা।
xxxxxx
খাতার গোছাটা নিয়ে বসতে গিয়েও হঠাৎ কি মনে হওয়ায় এক-পা এক-পা করে বইয়ের আলমারিটার দিকে এগোল পরমা। ওই তো, ডানদিক থেকে তিন নম্বর। গীতবিতানটা টেনে বার করতে গিয়েই নজরে পড়ল সেই পুরনো বাঁধানো ডাইরিটা। পরমার সেই স্কুললাইফ থেকে ডাইরি লেখার অভ্যাস, এবং আশ্চর্যভাবে এই দীর্ঘকালের অসংখ্য বাসা-বদল, শহর-বদল পেরিয়েও এই ডাইরিটা কেমন করে জানি থেকে গেছে। ডাইরিটা হাতে নিয়ে পাতা ওলটাল পরমা।
প্রথম পাতাতে ক্লাস সেভেনের কিছু তুচ্ছ হৃদয়-ভঙ্গের কথা, পড়ে হাসি পেল আজকের পরমার। পাতা উল্টোতে উল্টোতে স্কুল জীবন পেরিয়ে কলেজ জীবন, আকাশের সাথে ছাড়াছাড়ি, আদিত্যর সাথে দেখা, বাবা-মা কে বলা - সব ধরা আছে এই মলিন খয়েরি দুটো মলাটের মাঝখানে। কি আশ্চর্য, না?
তারপর, তিন দশক প্রায়, কিছুই লেখেনি কখনও। আবার এতগুলো বছরের তফাতে গত বছর থেকে আবার নতুন করে ডাইরি লেখা শুরু। শেষের কয়েক পাতা নেহাতই এখনকার জীবন - হেডমিস্ট্রেস হিসেবে স্কুলে প্রোমোশন, আদিত্যর চাকরি বদল, মিমির বিবাহোত্তীর্ণ নতুন জীবনের টুকরো-টুকরো ঘটনা, চারিদিকের ছোটবড় নানা খবর এবং তা নিয়ে পরমার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, প্রতিক্রিয়া, আরও নানা তুচ্ছ বিষাদ, অভিমান, ইত্যাদি। শেষ এন্ট্রিটা দেখে প্রথমে মজাই লাগলো পরমার - সচিন তেন্ডুলকরের রিটায়ারমেন্টের দিন লেখা। মনে পড়ল, ওইদিন আদিত্য পরমা দুজনেই সারাদিন টিভির সামনে থেকে নড়তে পারেনি, স্নান-খাওয়া মাথায় উঠেছিল। আর শেষে সচিনের ওই বাইশ-গজের পিচকে ছুঁয়ে বুকে হাত ঠেকানোটা দেখে আদিত্য অস্ফুটে বলে উঠেছিল - "সত্যিই, রিটায়ার করতে জানতে হয়!"
খানিকটা থমকে গিয়ে লেখাটার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পরমা। সত্যিই তো!
xxxxx
আবার ফোন। আদিত্য।
- আচ্ছা শোন, তুমি পারলে একটু মিষ্টি-টিষ্টি এনে রাখো। এতো ভালো একটা খবর, বাড়িতে কেউ এলে একটু মিষ্টিমুখ তো করাতে হবে।
- "সত্যি, তুমি এতো এক্সাইটেড আদিত্য।" হেসে ফেলল পরমা। "কেই বা আর আসছে বলো এখন? আজকাল কি আর কেউ আগেকার দিনের মতো না বলে আসে?"
তবু কি ভেবে ফোনটা রেখে পরমা বেরিয়েই পড়ল।
পুরনো পাড়া, বহুদিনের চেনা দোকান। দোকানদার একগাল হেসে বলল - "প-ঞ্চা-শ-টা রসগোল্লা! আপনার আর দাদার দুজনেরই তো সুগার, তাই না বউদি?"
পরমার চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টি তখন। কি যে ভাবছে নিজেও ঠিক তলিয়ে বুঝে উঠতে পারছে না। আনমনে উত্তর দিলঃ
- "নাহ, বলা তো যায় না, কখন লোকজন এসে যায়!"
xxxxx
বাড়িতে ফিরে ঘড়ির দিকে তাকালো পরমা। ইশ, দেখতে দেখতে চারটে বেজে গেল! আদিত্য আসবে আটটায়, মানে মাঝখানে আর চারটে ঘণ্টা মাত্র।
স্কুলের ঝোলাব্যাগটা টেনে নিয়ে স্টাডিতে এলো পরমা। খাতাগুলো প্রায় হয়েই এসেছিল, আর মোটে খান কুড়ি বাকি। ঝটপট বাকি খাতাগুলো দেখে নিয়ে যত্ন করে পরমা নম্বরগুলো টুকে রাখল গোলাপি রেজিস্টারে। তারপর একটা কাগজের টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে রেজিস্টারের ওপরের মলাটে আঠা দিয়ে টানটান করে লাগিয়ে টানা হাতের লেখায় একটা নোট লিখে রাখলো - "ক্লাস এইটের রিপোর্টকার্ড সামনের সপ্তাহে, অঙ্কের নম্বরগুলো কালই স্কুলে পৌঁছে যাওয়া দরকার।" লিখে নিচে সই করে তারিখটা বসিয়ে কাগজপত্র সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরলো পরমা। ঘড়িতে তখন পাঁচটা পঁয়ত্রিশ।
এবারে নিজের শোওয়ার ঘরে গিয়ে দেওয়াল আলমারি থেকে গোদরেজের চাবিটা নিয়ে পরমা চলে এলো মিমির ঘরে।
মিমির ঘরটা গত পাঁচ বছরে বিশেষ বদলায়নি। মিমি চলে গেছে বিদেশে পড়তে, তারপর বিয়ে-থা। এখন মিমি-শুভ বছরে একবারের বেশি আসতেই পারেনা। তাও বড়জোর দিন সাতেকের জন্য থাকা হয় এই ঘরে, বাকিটা শ্বশুরবাড়ি। যে মিমি মা-কে ছেড়ে এক রাত্তিরও অন্য ঘরে শুতে পারতনা, সে এখন কত্তো স্বাবলম্বী হয়ে গেছে, নিজের মনে ভাবলো পরমা। তারপর এগিয়ে গিয়ে আলমারিটা খুলে শাড়ি বাছতে বসলো।
এইসব শাড়িরও কত নানারকম স্মৃতি! এই ক্রিম-মেরুন আসাম সিল্কটা,এটা মিমির শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রণামীতে দিয়েছিলো। নীল বালুচরিটা একবার আদিত্য নিজে হাতে করে কিনে এনেছিল; পরমা তো অবাক, আদিত্য আবার শাড়ি-টাড়ি চেনে নাকি! এই আসমানি রঙের ঢাকাইটা, এটা মিমি দিয়েছিলো ওর প্রথম স্টাইপেন্ডের টাকা দিয়ে। শাড়ীগুলো আনমনে ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘড়ির আওয়াজে হঠাৎ চমক ভাঙল, ইশ, ছ'টা বেজে গেল!
ক্ষিপ্র হাতে শাড়িটা খুঁজে বার করল পরমা। ওর বিয়ের বেনারসি। উল্টেপাল্টে দেখে বুঝল, জরি ফেঁসে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। সে যাক গে! ব্লাউজটা তো গায়ে হওয়ার প্রশ্নই ওঠেনা, তাই তাড়াতাড়ি করে যাহোক ম্যাচিং একটা লাল ব্লাউজ খুঁজে নিল। তারপর তোয়ালে, সাবান সব নিয়ে স্নানঘরে গিয়ে দীর্ঘসময় ধরে স্নান করল সে। মনে মনে একটা আশঙ্কা চলছে যদিও, দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো! তবু অস্থিরতা কাটিয়ে ধীর হাতে শ্যাম্পু করল চুলে, কন্ডিশনার লাগালো। মিমির দেওয়া বিদেশি সুগন্ধি বডি-জেল, যেটা ছ'মাসের ওপর শুধু তুলেই রাখা ছিল, আজ নামালো পরমা। শাওয়ারের দিকে মুখ তুলে অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে জলটাকে পুরো শরীর দিয়ে গ্রহন করল, তারপর নিজেকে ভালবেসে, যত্ন করে, আদর করে স্নান করল সে। তারপর বেরিয়ে এসে পরিপাটি করে শাড়িটা পরল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। চুল আঁচড়ে, মাঝখানে সিঁথি করে, চিরুনির ধার দিয়ে মোটা করে সিঁদুর পড়ল সিঁথি জুড়ে। না, কেনা টিপ নয়, তর্জনীতে সিঁদুর নিয়ে সুন্দর করে গোল করে সিঁদুরের টিপ আঁকলো কপালে। দেরাজ খুলে শাঁখা-পলা বার করে পরল; আজকাল এগুলো পুজোপার্বণের জন্যেই তুলে রাখা হয়।
তারপর মিমির আলমারি খুলে একটা ওড়না পছন্দ করল সে। প্রথমে ম্যাজেন্টা রঙের ওড়নাটা পছন্দ হয়েছিল, কিন্তু পরনের লাল বেনারসিটার সঙ্গে ম্যাচ করে একটা লাল জরিপাড় দেওয়া ওড়না বেছে তুলে নিল পরমা। তারপর শোওয়ার ঘরে খাটের ওপর চেয়ারটা তুলতে গিয়েও হঠাৎ কি মনে হওয়ায় ফিরে গিয়ে সদর দরজার ছিটকিনিটা খুলে রেখে এলো সে। আদিত্য ঢুকবে কি করে, নাহলে?
xxxxx
আদিত্য যখন আটটা পনেরো নাগাদ ঘরে ঢুকল, পরমার শরীরটা তখনও উষ্ণ গরম। পা-দুটো বিছানার থেকে ফিট খানেক ওপরে হালকা দুলছে। হাতের মুঠো আলগা, তার ফাঁকে একটা ছোট্ট চিরকুট -
"ভালো থেকো, আদিত্য। মিমি, ভালো থাকিস মা!"
অসম্ভব ভাল। আমি রীতিমত ইম্প্রেস্ড্।
ReplyDeleteবিশ্বাস হল না!
Deleteহুম, বেশ মন খারাপ করে দেওয়া ভাল একটা ব্যাপার।
ReplyDeleteThank you so much. Hna, likhe amaro besh mon kharap i holo. :(
DeleteHaan, anekrokom kichhu...nischintey r thaka gelo na re Topshe!!
ReplyDeleteShei.. Tobe, shantite triptite mrityuboron ta ekta lobhoniyo byapar noe? Janina keu keno ekmot hochchhe na! :(
DeleteTui ei golpota erokom bhabe keno sesh korli? What exactly was going in your mind when u started writing it?
ReplyDeleteProthomthekei ei porinotitai bherbechhilam re, ar seta develop kortei golpota dar korano.. Prochur hints o diechhi golpota jure, kheyal korish.. Timely retirement, swechchha mrityu, shantite mora, egulo ki amra chaina?
ReplyDeleteAr, suicide manei ki nijer lokjonder opor raag kore chole jete hobe? She still cared how her husband willenter the house and fixed it before she died.
ReplyDeleteHi Shinjini. Lekhata bhalo, kintu chintadhara ta mantey giye
ReplyDeletehochot khelam. Mrityushojjay manush key paramayur
kamana kortey dekhchi je.
Ghotona! Swechchha mrityu, kintu shwo-ichchha ta khub golmele jinish. :)
Deleteখুব সুন্দর এবং পরিণত লেখা, চমৎকার চরিত্রায়ন এবং ঘটনাবিন্যাস। কিন্তু পরিসমাপ্তিটা আমি সবেগে প্রত্যাখ্যান করছি। যদি শেষ অধ্যায়-এর অঘটনটাকে গিমিক না ধরে সত্যি মনে করি, তাহলে লেখায় ভদ্রমহিলার যে মাইনর দুঃখ বা আবেগ ফুটে উঠেছে, সেগুলো নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর হয়ে ওঠে; ওনার নিঃসন্দেহে ক্লিনিকাল ডিপ্রেশন ছিল, মোস্ট লাইকলি আনডায়াগনোজ্ড, নইলে এরকম সুইসাইডাল আইডিয়েশন হয়না। কিন্তু ব্যাপার হল, সেরকম হলে একদিনে দুম করে কিছু হয়না, তার অনেক রকম ছোট ছোট চিহ্ন থাকে, অনেক দিন ধরে একটু একটু করে প্রকট হয়। আদিত্য যদি সেগুলো খেয়াল না করে থাকে, তাহলে সে হয় অন্ধ বা মূর্খ।
ReplyDeleteএই আত্মহত্যাটা অত্যন্ত স্বার্থপর একটা কাজ হল। ভদ্রমহিলা নিজের মুক্তির পথ বেছে নিলেন, কিন্তু আদিত্য এবং মিমি-র ওপর সারাজীবনের গিল্ট এবং গ্লানির বোঝা চাপিয়ে গেলেন।
Thank you so much. Learning curve. :)
DeleteE abar ki? boro dukkho hochhe j? ofc er modhye chokhe erom jol ele kaaj korbo ki kore?
ReplyDeleteSharthopor laglo Parama k ... abar ekta poornota o pelo o
kintu tao monta dukkhi hoye gaelo
Amaar mone hoini je Parama swarthopor chilen. Hoito swarthopor chilen na bolei eta korlen.
ReplyDeleteVirginia Woolf er Mrs. Dalloway ki swarthopor chilen?
Sharthoporotar proshno noe.
Deletekeno? keno? keno? :(
ReplyDeleteওই যে, মুক্তি! :)
Deleteদারুন লাগলো বললে কম বলা হয় :)
ReplyDeleteএটা কি নিছকই আর কিছুই পাওয়ার নেই , এই তৃপ্তিতে রিটায়ার্ডমেন্ট নাকি এটা জীবনানন্দের "বোধ" যা সব কিছু পাওয়ার মাঝেও একা করে রাখে, ক্লান্ত করে প্রতিনিয়ত ।
ReplyDeleteShob pawar bhaar ta beshi na anondo ta, eta kintu kothin proshno! plus, klaantitao ekta factor botey :)
DeletePoroma-r ekdin golpo ta bhalo legechhe.. kintu liberation ta mrityu na hoye songsar chhere berie jawao hote parto...... because she gave it all and now she had no burden...
ReplyDeletebut storyline was riveting indeed. keep up the good work :)
সংসারে থেকে কি সংসার ছেড়ে বেরনো যায়, সত্যিই?
Delete