(১)
আমার বিয়ের সময় অনির্বাণের
কয়েকজন বন্ধু বড়কাকাকে দেখে বেশ চমকে গিয়ে বলেছিলঃ “উরিব্বাস! ইনি কে জানিস? এ কে বাসু! ইউনিভার্সিটিতে সবাই এনাকে ভগবান বলে মানে।“ আমি
অবাক হয়ে বলেছিলাম, “ধুর! ওটা তো বড়কাকা!”
১৮ই জুলাই ২০১৬ তে অর্থাৎ বড়কাকার কাজের দিন ঠিক সেই ব্যাপারটাই আবার
হল। নানান ক্ষেত্র থেকে
অতিথিরা এসেছেন যারা বড়কাকাকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন, তাঁরা “স্যর”
বলে উল্লেখ করে নানা কিছু স্মৃতিমন্থন করছেন, অতীতচারণা
– ইউনিভার্সিটির কথা, ওনার পড়ানোর কথা…
আর আমার মনে হচ্ছে - “ধুর! ওটা তো বড়কাকা!”
বড়কাকাকে
নিয়ে লিখতে হবে।
কিন্তু যাই লিখবো, মনে হবে যেটা বলতে চাই সেটা বলা হলনা।
বড়কাকাকে ডেস্ক্রাইব করার চেষ্টা করাটাও বোধ হয় – সে যতই পাতার পর পাতা ভর্তি করে লিখি না কেন – শেষে ওই অন্ধের হাতি দেখাতেই পরিণত হবে।
আসল কথাটা হল, বড়কাকা
মানুষটার ব্যাপ্তি আর গভীরতা দুটোই এতটাই বেশি, যে একটা সামান্য লেখায় ওনার স্মৃতিকে ধরতে যাওয়ার চেষ্টা করাটাই বাতুলতা, অথবা হয়ত একপ্রকার ইঞ্জাস্টিস করা।
বড়কাকা একটা প্রিজমের মতন – এক একদিক থেকে আলো ফেললে এক একরকমের রামধনু-রং বিচ্ছুরিত হয়, আর তার
প্রত্যেকটাই আপন দ্যূতিতে উজ্জ্বল!
তবু, বিন্দু
বিন্দু দিয়ে সিন্ধু ধারণ করার একটা অক্ষম প্রয়াস…
তবে শুরুর মুখেই
সামান্য ভুমিকা করা জরুরি। বড়কাকার কাজে এসে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে উনি
আমার কে হতেন। খুব একটা গুছিয়ে উত্তরটা দিতে পারিনি অতটুকু অবকাশে। আসলে, আমি ওনার
পাশের বাড়িতে থাকি, মানে থাকতাম। আর আমার বেশ বড় বয়স অবধি আমি জানতাম যে আমার দুটো
বাড়ি –একটায় আমার মা বাবা ভাই থাকে আর একটায় বড়কাকারা থাকে। পাশাপাশিই, একটা পাঁচিলের
তফাৎ - আর সেই পাঁচিল টপকিয়ে এবাড়ির বাতাবী লেবু গাছ থেকে ওবাড়িতে ফল পড়ে, আর
ওবাড়ির নিমগাছ এবাড়িতে ঠান্ডা হাওয়া পাঠায়। অনেকদিন অবধিই আমি এটা বুঝতাম না যে
ওটা আলাদা একটা পরিবার; আমি ভাবতাম – একটা বাড়িতে লোকে যেরকম আলাদা আলাদা ঘরে
থাকে, তেমন বেশি লোক হলে তারা ভাগাভাগি করে দুটো আলাদা বাড়িতে থাকে, যেমন আমাদের
বাড়ি আর “ওদের বাড়ি”। ছোটবেলায়
আমার দিনের বেশিরভাগটাই কাটতো “ওদের বাড়ি”তে।
আজও আমাদের বাড়িতে কিছু দূরসম্পর্কের আত্মীয় এসে আমাকে দেখে মজা করে বলে – “একি, ওদের বাড়ির
মেয়েটা এখানে কি করছে?”
আমাদের
ছোটবেলায় ওদের বাড়িটা যে ঠিক কতটা সরগরম ছিল, সেটা যারা দেখেনি তারা ধারণাও করতে পারবেনা।
প্রতিদি সন্ধ্যেবেলা ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সাড়ে সাতটায় চায়ের আসর বসত, সাথে একটা স্পেশাল মুড়ি চিঁড়ে ভাজা।
তখন প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে একটু পরেই আমি কাকিম্বাবার কাছে পড়তে
যেতাম, ওদের বাড়ির দোতলায়।
আমার জ্ঞান হওয়া অবধি কাকিম্বাবা আমার অঙ্ক ছাড়া আর যাবতীয় সাবজেক্টের টিউটর; অঙ্ক করাতো কুটুপুসু, ছুটির দিনে সকালগুলোয়। তা কাকিম্বাবা যখন
সেক্সপিয়ার বা দান্তে বা কিপ্লিং পড়াতো তখন মন দিয়ে শুনতাম, কিন্তু ওই – লিটারেচার বাদ দিয়ে হিউম্যানিটিসের বাকি সাবজেক্টের প্রতি আমার চিরকালের অনীহা! কাকিম্বাবা অক্লান্তভাবে ধৈর্য সহকারে আমাকে হিস্টরি, জিওগ্রাফি ইত্যাদি সাবজেক্টগুলো প্রায় লাইন
ধরে ধরে রিডিং পড়ে শোনাত, আর আমি ভীষণ বোর হয়ে হয় ঝিমোতাম নয় গল্পের বই পড়তাম। আর
মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে চোখ রাখতাম – সওয়া সাতটা বাজতে পারতনা, আমি মনে করিয়ে দিতাম
যে টাইম হয়ে গেছে, এবার নীচে চলো চা করতে হবে। আমার একটা ছোট সাইজের স্পেশাল কাপ
প্লেটও ছিল। চায়ের আসরে কুটুপুসুর বন্ধুরা, মাঝেমাঝে বড়কাকার ছাত্ররা, আর পাড়ার
লোকজনেরা সবাই মিলে বসে জমিয়ে গল্প হত – না, শুধু ছুটির দিনেই নয়, প্রতিদিন। চা
শেষ হয়ে গেলে আমি আর পারতপক্ষে কাকিম্বাবার ধার ঘেষতাম না, সোজা লুডো খেলতে বসে যেতাম, আর তারপর লোডশেডিং হয়ে গেলেই মশা মারার কম্পিটিশন করতাম। এখন আর রামও নেই আর
অযোধ্যাও নেই। কিন্তু যখন ছুটিতে কলকাতা আসি, একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে ওদের বাড়িতে
গিয়ে বড়কাকা আর কাকিম্বাবার সাথে আড্ডা। মানে, থাকত!
(২)
বড়কাকার গল্প করতে
গেলে ঠিক কোথা থেকে যে শুরু করি! কালীপুজোর ব্যাপারটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি পরিচিত সবার কাছে, তাই
ওখান থেকেই শুরু করা যাক!
আমাদের দুটো বাড়িতে –
অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে আর ওদের বাড়িতে – শুনেছি সেই ‘৮২ সাল থেকে কালীপুজো চালু হয়েছিল। আমাদের বাড়ির পুজোটা অবশ্য
বহু বছর হল বন্ধ হয়ে গেছে। আমারই ভাল, কারন আর কোন দোটানা রইল না। আর তাছাড়া
এমনিতেও ওদের বাড়ির পুজোটাই বেশি করে “আমার” ছিল। তা হঠাৎ সেবার একবার বড়কাকার মাথায় কি পোকা নাড়া দিল কে জানে, সে বছর কুমোরটুলিতে বারণ করে দিল ওদের প্রতিমা বানাতে। তারপর একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসে
দেখি - একটা চার চাকার সাইকেল ভ্যানে করে
বাঁশ এলো, খড়ের আঁটি, নারকোল দড়ি, একটা দাঁ। অতি উৎসাহে ভ্যানের পিছন পিছন ছুটলাম।
বড়কাকা বলল – “দেখবি, কি হয়?” বাঁশগুলো
মাঝারি সাইজের টুকরো করে কাটা হল প্রথমে, তারপর ওই নারকোল দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেঁদে একটা কাঠামো দাঁড় করান হল। পিসার
টাওয়ারের মত বাঁদিকটা একটু হেলে রইল, কিন্তু সে যাগগে! তারপর খড় দিয়ে ভাল করে
পেঁচিয়ে মুড়িয়ে একটা যাহোক কিছু একটা অবয়ব তৈরি হল। একটা না,
স্যরি, দুটো। একটা দাঁড়ানো – সেটা দিয়ে কালীঠাকুর হবে, আর
একটা শোওয়া – অর্থাৎ শিব! কোমর একটা দিক ফুলে থাকল, হাত একটা ছোট একটা বড়, গলা ঘাড়
কাঁধ সব একশা – যা হোক কিছু একটা হল! পরম
উৎসাহে প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই দৌড়ে চলে যেতাম এই অভূতপূর্ব নির্মাণকার্য
দেখতে, আমাদের চোখের পলক পড়ত না। আর তারপর
ক’হপ্তা ধরে ঠাকুরের স্কেলিটন বানানোর পর একদিন সাদা
প্লাস্টিকের বস্তা ভর্তি মাটি এল, আর তার সাথে কোদাল। মাটির তাল বানিয়ে জল মিশিয়ে
কোদাল দিয়ে কুপিয়ে খড়ের গায়ে মাটি লেপে তার ওপর দিয়ে ছোট ছোট
ভিজে কাপড়ের টুকরো দিয়ে পুরোটা কভার করে, শুকিয়ে নিয়ে তার ওপর দিয়ে রঙ করে গর্জন
তেল দিয়ে... সোলার শীট দিয়ে চাঁদমালা
বানিয়ে আমাদের কালী ঠাকুর, শিব ঠাকুর,
মুন্ড মালা মায় ইঁদুরের মত দেখতে একটা শিয়াল পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল দিব্যি। আর
সবচেয়ে বড় কথা হল যে, সেই যে হঠাৎ একবছরের হিড়িক, সেটাই পরে প্রতি
বছরের নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমদিকে দু’এক বছর তো বড়কাকার নির্দেশে বুড়িদিকে একটা পা সামনে আরেকটা পা
পিছনে করে দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে পোজ দিয়ে দাঁড়াতেও হত; জিভ
বার করে দাঁড়াতে হত কিনা সেটা অবশ্য আমার এখন আর মনে নেই! বছর কয়েকের মধ্যে মূর্তি
বানানোর কাজে বড়কাকার হাতটা পেকে গেল, তারপর থেকে প্রতিমাটা অল্মোস্ট প্রফেশানাল
লেভেলের নিখুঁত হতে লাগল। বাই দ্য ওয়ে, বড়কাকা কিন্তু কোনদিনই ছাঁচ ব্যবহার করত
না, হাত দিয়েই বানাত পুরোটা। আর সুব্রতদা নেকড়ে বা শিয়াল কিছু একটা বানাত যেটা
প্রত্যেক বছরই আলাদা আলাদা ধরনের কোন প্রাণী
সমদৃশ হত। গত বছর মানে ২০১৫তে অবশ্য পুরো প্রতিমাটাই সুব্রতদা বানিয়ে ছিল,
আর সেটা রীতিমতন ইম্প্রেসিভ হয়েছিল! এখন ভাবলে মনে হচ্ছে,
বড়কাকা বোধ হয় চলে যাওয়ার আগে কাজটা একদম গুছিয়ে ট্রাঞ্জিশন করে গেল আগে থেকেই।
এই কালীপূজোর জন্যই ছোটবেলায়
পুজোয় পাওয়া সবচেয়ে ভাল জামাটা না পরে তুলে রাখা, আবার এই কালীপূজোর জন্যই পরবর্তীকালে সব বন্ধুদের অনুরোধ ফেলে দুর্গাপুজোয় ছুটি না নেওয়া, যাতে কালীপূজোয় বাড়ি
আসতে পারি। তাও দু-তিন বছর অন্তর অন্তর, বড়জোর। যে বছরগুলো পারতাম না আসতে, বড়কাকাকে ফোন করতেই ভয় করত। আগেই বাবার থেকে জানে যে আসব না, তাও বারে বারে বলবে – “দেখ না, পারিস কিনা?” কি যে মন
খারাপ হয়ে যেত বারবার করে না বলতে! তবে যে ক’বার আসতে পেরেছি রিসেন্টলি, সেগুলোর স্মৃতি অমুল্য। এই কালীপূজোতেই, এটা অনেক বছর আগেকার গল্প, বড়কাকার ছাত্রদের সাথে মিলে
অন্ত্যাক্ষরি খেলা তো হতই, আর সেবার একবার হঠাৎই আবৃত্তির আসর
বসলো। মনে আছে, উদয়ভানুদা পুরো ক্যামেলিয়া-টা মুখস্ত বলেছিল, সেই আমার ক্যামেলিয়ার সাথে প্রথম পরিচয়! আমি বোধ হয় রক্তকরবীর একটা দুটো সিন পড়েছিলাম। মা বোধ হয় “আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি” বলেছিল। বিবেকানন্দদা
গান করেছিল। পীযূষদা কবিতা কি
বলেছিল মনে নেই, কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের গলা নকল করে “কভি কভি…” –টা মনে আছে। অমলদা, সুব্রতদা, নিউব্যারাকপুরের গৌতমদা, আর অনেকের নাম মিস করছি নিশ্চয়ই… খুব মজা হত তখন। আর একবার যেবার সারপ্রাইজ দেব বলে বড়কাকাকে না জানিয়ে চলে
এলাম কালীপূজোর দিন সকালে, আমার মেয়ে তখন ছ’মাস, বড়কাকা যে কি খুশি হয়েছিল! সবাইকে গিয়ে গিয়ে বলছিল – “এই দেখো, টুয়া দিল্লি থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছে।“ তবে আগেরদিন সন্ধ্যেবেলায়
বসে গঁদের আঠা আর রঙিন কাগজ দিয়ে শিকল বানানো, ডিজাইন করে শাদা কাগজ কেটে জুড়ে ডিজাইন বানানো,
বা আরও দুদিন আগে থেকে বসে ছাঁচে ফেলে নারকোলের মিষ্টি বানানো,
এগুলো আজ বহুবছর আর করা হয়নি…
(৩)
বড়কাকার খ্যাপামির
নমুনা অজস্র, শত সহস্র - সবকিছুই ওই ওয়ান-ফাইন-ডে হিড়িক উঠল, আর তারপর... না,
গন্ডার মারা হল না বটে, কিন্তু যেমন একটু একটু করে একটা আস্ত তিন কামরা-ওয়ালা দোতলা
উঠে গেল ওদের একতলা বাড়ির ওপরে, সিঁড়ি ইত্যাদি সহকারে, স্রেফ বড়কাকার একলা হাতের
খেলে!
ওই দোতলার ছাদটার
কিছু বিশেষ স্মৃতি আছে আমাদের ছোটবেলার। আমরা পাড়ার বাচ্চা-কাচ্চারা মিলে, বিশেষ
করে বিট্টু আর বাবুয়ার উদ্যোগে, ফি বছর গরমের ছুটিতেই নতুন করে
একটা ক্লাব এবং একটা লাইব্রেরি চালু করতাম। পাড়ার মা-কাকিমাদের থেকে মেম্বারশিপ ফি বাবদ খুচরো পয়সা নিতাম এবং রসিদ কেটে দিতাম। রসিদের নীচে সইটা অবশ্যই প্রতিবছর হাতের লেখার উন্নতি বা অবনতির সাথে সাথে বদলাত। অবশ্যই, প্রত্যেকবছর নতুন করে উদ্যম এবং নতুন করে নামকরণ করা হতো। ক্লাবের নামকরণ
নিয়ে দু'রাত্তির ঘুম হতনা।
আরেকটা কথা না বললেই
নয়! কিন্তু তার আগে বলে নিই – বড়কাকার একতলায়
পড়ার ঘরটা, যারা গেছেন তাঁরা জানেন যে
সেটার ডিজাইনটা এরকম - ঢোকার দরজাটা বাইরের দিকে
খোলে, আর ঘরে ঢুকেই ডানদিকে বড়কাকার পড়ার টেবিল। বাকি ঘরটা ওয়াল টু ওয়াল দেওয়াল
আলমারি জোড়া বইয়ের কালেকশন, প্রায় সিলিং অবধি। ওই ঘরটায় সংবচ্ছর প্রতিবেশী,
ছাত্রছাত্রী, বাংলাদেশের গ্রামের লোকজন, পরিবারের লোক বা আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা
লেগেই থাকে, সকাল থেকে সন্ধ্যে। তা
ব্যাপারটা হল কি, যে বড়কাকা হঠাৎ একদিন রিয়ালাইজ করল যে দরজা দিয়ে কেউ ঢুকলেই
বড়কাকাকে কষ্ট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে হয় যে কে এলো। যেমনি রিয়ালাইজেশন তেমনি কাজ,
মানে ওই যে বলে না – নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন, তাইই।
কোথা থেকে জোগাড় হল জানিনা, কিন্তু সেবছর গিয়ে দেখি – ওমা
একি! ওই অটোতে সামনে যেমন থাকে চালকের সীটের দু’দিকে দুটো,
তেমন দু’খানা রিয়ার-ভিউ মিরর বসে গেছে
বড়কাকার টেবিলের মুখোমুখি দেওয়াল আলমারিটার গায়ে। এমনি তার পজিশন আর এমনি তার অ্যাঙ্গেল, যে
দরজা দিয়ে কেউ ঢুকলেই বড়কাকার সীট থেকে ঘাড় না ঘুরিয়েই পষ্ট মেপে নেওয়া যাবে
অতিথিকে।
(৪)
এইসব আজগুবি উদ্ভট
আইডিয়ার ব্যাপারে বড়কাকার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এইসব গল্প শুনে যতই মনে হোক না
কেন যে মানুষটা নিশ্চয়ই খুব খ্যাপাটে বা বোহেমিয়ান গোছের, নিজের দৈনন্দিন
রুটিনের ব্যাপারে কিন্তু আবার বড়কাকা সাঙ্ঘাতিক কড়া ডিসিপ্লিনের মানুষ। ইভন এক
গ্লাস জল পর্যন্ত কখন খাবে, তার টাইম একদম ফিক্সড! বহুদিন হয়েছে যে আমরা সবাই মিলে
অন্য ঘরে বসে গুলতানি মারছি, হইচই করছি, জোরে জোরে হাসছি, কথা বলছি, লুডো খেলতে
বসে চোট্টামি করছি, ঝগড়া করছি... কিন্তু পাশের ঘরেই বড়কাকা একটা অবিচল, শান্ত
স্থিতিতে বসে একনাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছে। একটা কন্সট্যান্ট খট খট আওয়াজ আসছে টাইপরাইটার
থেকে, মাঝেমধ্যে বইয়ের পাতা ওলটানোর আওয়াজ... একদিনও কোনোভাবেই সেই অভ্যাসের এক
চুল এদিক ওদিক হত না। কাকিম্বাবা রেকাবীতে সাজিয়ে এক কাপ হরলিক্স, বা গ্লাস ভর্তি টলটলে জল তক্ষুনি টিউব অয়েল থেকে তোলা, এসব ঘড়ি ধরে বড়কাকাকে পাঠাত একতলা থেকে দোতলার পড়ার ঘরে, আমাদের হাত দিয়ে।
আমি যেদিন যেদিন নিয়ে যেতাম, পাছে চলকে পড়ে এই আশঙ্কায় অতি অবশ্যই প্রতি পদক্ষেপে গ্লাসে বা কাপে চুমুক দিতে দিতে যেতাম।
সাংসারিক বা সামাজিক দিক থেকে দেখতে
গেলে কিন্তু আবার, বড়কাকার চারিদিকে একটা দুর্ভেদ্যরকমের দূরত্বের প্রাচীর ঘেরা থাকত
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, অন্তত এই কয়েক বছর অবধিও। বড়কাকার অত্যন্ত কাছের লোকেদের কাছেও
বড়কাকা বেশ খানিকটা আনআপ্রোচেবল ছিল – খুব কম কথা বলত, বললেও বেশ গম্ভীরভাবে। মানে,
কোন ব্যাক্তিগত আলোচনা, রাগ- দুঃখ - ইচ্ছে - অনিচ্ছের কথা শেয়ার করা তো দূর অস্ত, এমনকি
রেজাল্ট বেরনো বা চাকরি পাওয়ার মতন খবর দিতে যাওয়ার আগেও সবাই মনে মনে রিহার্সাল দিয়ে
নিত আর ঢোঁক গিলত কথা বলতে গিয়ে! এই ব্যাপারটার অবশ্য পরিবর্তন হয় পরে; বিশেষত গতবছর
দিদা চলে যাওয়ার পর বড়কাকা অনেক অন্যরকম হয়ে গেছিলো, প্রচুর কথা বলত সবার সাথে, বেড়াতে
যেত। তবে তখনও আমরা যারা আরেকটু ছোট ছিলাম, আমাদের একটা বিশেষ
ছাড় ছিল এই ব্যাপারে - আমরা বড়কাকাকে খুব একটা পরোয়া করতাম না বা ভয় পেতাম না কোনকালেই!
বিট্টু তো বড়কাকার কাঁধে চড়েই সারাক্ষণ এদিক ওদিক বেড়াতে যেত। আর আমার নিজের ক্ষেত্রেও
যতদূর মনে পরে, আমার এ বি সি ডি প্র্যাকটিস করার জায়গা ছিল বড়কাকার টাইপ-রাইটার। তখন
বড়কাকার পড়ার ঘর ছিল দোতলায়। স্কুল থেকে ফিরে প্রায়ই চলে যেতাম সোজা, আর বলতাম – “তুমি
অনেকক্ষন লিখেছ, এবারে আমি লিখবো।“ বড়কাকা নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকত কিন্তু কখনই না বলত
না, অম্লানবদনে নিজের লেখার কাগজটা টেনে বার করে নিয়ে একটা ব্ল্যাংক শিট সেট করে টাইপ-রাইটারটা ছেড়ে দিত; আর আমিও মনের সুখে
নিজের নাম, বড়কাকার নাম, এ ফর অ্যাপেল ইত্যাদি লিখতে থাকতাম।
ইন ফ্যাক্ট, বড়কাকার আমার পড়াশোনার প্রতিটা স্টেজেই আমাকে
কোন না কোনভাবে প্রচুর সাহায্য করেই গেছে। বিশেষ করে আইএসআই-তে পড়ার সময় তো সেভাবে
আমাদের সিলেবাস বলে কিছু হতনা, নানান পাব্লিশড পেপার বা জার্নাল থেকে রেফারেন্স জোগাড়
করে প্রিপেয়ার করতে হত আর সেগুলো মোটেই সহজলভ্য ছিল না। বড়কাকা দিনের পর দিন শুধু সিইউ-য়ের
লাইব্রেরি থেকেই নয়, ব্রিটিশ কাউন্সিল বা ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকেও বই বা জার্নাল ইস্যু
করে এনে দিত। আমার বন্ধুরা সবাই এই ব্যাপারে আমার ওপর ডিপেন্ড করত, আমার থেকে নোটস
জেরক্স করে নিত। আর গল্পের বইয়ের ক্ষেত্রেও,
ছোটবেলায় বা বিশেষ করে স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসের বয়েসে অর্থাৎ যখন আর পাড়ার কল্যান-সমিতির
লাইব্রেরির বই-এর স্টকে আমাদের আর পুরোপুরি পোষাচ্ছে না, তখন হাতখরচের টাকা জমিয়ে যেই
একটা টার্গেট অ্যামাউন্টে পৌঁছত, সব খুচরো
পয়সা ছেঁড়া নোট জড়ো করে বড়কাকার কাছে নিয়ে আসতাম, আর সঙ্গে একটা বাকেট-লিস্ট। বড়কাকা
ঠিক পরেরদিনই ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কলেজ স্ট্রিট থেকে বেশ হেভি ডিস্কাউন্টে
বইগুলো কিনে এনে দিত। ইন ফ্যাক্ট, বইমেলার কথাও যদি ধরা যায়… আমার সমবয়সিদের বেশীরভাগেরই
বইমেলা সংক্রান্ত যাবতীয় নস্টালজিয়া শুনি কলেজ-ফেরত বন্ধুরা মিলে বইমেলা গিয়ে বেনফিস, ইত্যাদি। আমাদের
কিন্তু বইমেলায় যাওয়া অনেক, অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল আর সেটা অধিকাংশই বড়কাকা আর
কাকিম্বাবার সাথে। ওরা ছাড়া আর কারই বা অত ধৈর্য থাকবে, যে কিনতে পারছি না এমন সব লোভনীয়
বইগুলো কাউন্টারে দাঁড়িয়ে অর্ধেক পড়ে মেরে
দেব আর কেউ একবারের জন্যেও তাড়া দেবে না! গেট নাম্বার বলা থাকত; আমি আর কাকিম্বাবা
মধ্যমগ্রাম থেকে যেতাম, আর বড়কাকা ইউনিভার্সিটি ফেরত আমাদেরকে মীট করত। আর ফেরার সময়
দুহাতে ব্যাগ ভর্তি বই আর সেইসাথে মুখে বিশ্বজয়ের আনন্দ!
(৫)
ছোটবেলায় আমাদের আরেকটা সাপ্তাহিক রিচ্যুয়াল ছিল হাটে যাওয়া। সপ্তাহের কোন একটা দিন, বুধবার
নাকি বৃহস্পতিবার ভুলে গেছি, আমাদের ওখানে হাট বসত। আমি, আর পরবর্তীকালে বিট্টু একটু
বড় হওয়ার পর বিট্টুও, ওইদিনটায় স্কুল থেকে ফিরে আর ঘুমতাম না, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে
থাকতাম যে কখন চারটে বাজবে আর আমরা বড়কাকার সাথে হাটে যাব। বাদু রোডে, সেই শ্রীকৃষ্ণ সিনেমা হল পেরিয়ে, বেশ
কয়েক কিলোমিটারের রাস্তা। বড়কাকা তো লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটত, আমরা পিছিয়ে পড়তাম।
তা যতক্ষণ পারতাম পিছন পিছন দৌড়োতাম, আর তারপর বাকি রাস্তাটা বড়কাকার কাঁধে করে যেতাম।
আর ফেরার সময় দু’হাত ভর্তি বাজার নিয়ে ভ্যানে
করে ফেরা হত। সেই ব্যাগে মরসুমি ফল থেকে শুরু করে নানারকমের ছোট বড় মাছ, শাক শব্জি,
সব। ওই হাটের কথা মনে পড়লেই ওই লাইন করে পেতে
রাখা শুঁটকি মাছের গন্ধ যেন এখনও নাকে ঝাপটা মেরে যায়। বড়কাকার ব্যাপারে আমরা বাচ্চারা
চিরকালই বেশ পজেসিভ ছিলাম। কাকিম্বাবা যদি কখন সাথে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করত, বিট্টু
নাকি বলতঃ “মেয়েলা হাতে যায়না, আল গেলেও পলে যায়।“
যেবার ওদের বাড়ির পাশের ফাঁকা জমিটায় কুয়ো খোঁড়া হল, আমাদের
কি মজা! ছুটির দিন হলেই সক্কাল সক্কাল পৌঁছে যেতাম এক সেট চেঞ্জ আর একটা টাওয়েল নিয়ে।
বড়কাকাও নিজের টাইপরাইটার বন্ধ করে একটা গামছা নিয়ে চলে আসত, আর গামছাটা ভিজিয়ে দলা
পাকিয়ে স্টপারের মত করে আটকানো হত ড্রেনের মুখটা। তারপর বালতি বালতি জল তুলে আমাদের
সিমেন্টের চৌকো মিনি বাথটাব! স্কুলে গিয়ে সে কি গর্ব – “জানিস, আমাদের কুয়ো আছে!!”
আমাদের স্কুলবয়েসের আরেকটা ব্যাপার
এখনও মনে পড়লে বেশ মজা লাগে। আমরা “তখনকার দিনে” ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তাম। তা, এটা নিয়ে
ঘরে বাইরে পাড়ায় সবসময়েই উল্টো রকমের একটা কমপ্লেক্স হত – পাড়ার মাঠে
অন্য স্কুলের বাচ্চারা খেলায় নিত না, আর চারিপাশেও প্রচুর লোকে নানারকম ‘কথা’ বলত।
বহুবারই হয়েছে, বড়কাকার ঘরে ঢুকছি, হয়ত বড়কাকার কোন না কোন ছাত্র বা পরিচিত কেউ বসে
আছে। তা, সেই “কি গো, কত বড় হয়ে গেছ, কোন স্কুলে পড়?” পেরিয়ে এসে অবধারিতভাবে একটা
কমেন্ট এসেই পড়ত, যে – নিজের ছেলে/ মেয়েকে ইংরেজি মিডিয়ামের স্কুলে পড়াব না বাবা, ইংরেজি
মিডিয়ামের বাচ্চারা বাংলা জানেনা। আর বড়কাকা এটা শুনলেই সাথে সাথে খুব প্রটেস্ট করত,
আর আমাদেরকে দেখিয়ে প্রমাণ পেশ করত। বড়কাকার এটা খুব ভাল লাগত যে আমি আর বিট্টু বাংলাটা
মোটামুটি পড়ি, চর্চা করি। সেই কথাটা মনে রেখেই,
বড়কাকা দেখো - তোমাকে নিয়ে এই লেখাটা আমি বাংলাতেই
লিখলাম কিন্তু!
আমার প্রতিবার নতুন ক্লাসে ওঠার সময় যে খাতা বই আর সাথে
ব্রাউন পেপারের মলাট আর নেমপ্লেট আসত, সেগুলো পাওয়া মাত্র প্রথম কাজ হত বাবাকে দিয়ে
সেগুলো সব মলাট দেওয়ানো, আর তারপর দ্বিতীয় কাজ হত সেসবকিছু নিয়ে সোজা বড়কাকার কাছে
চলে যাওয়া। বড়কাকা একটা অবিশ্বাস্যরকমের সুন্দর হাতের লেখায় আমার নাম, ক্লাস, সেকশন,
সাব্জেক্ট লিখে দিত সব খাতা বইয়ের মলাটে। যতই ব্যস্তই থাক, যখনি যেতাম কোনদিনই একটুও
অপেক্ষা না করিয়েই কিন্তু সাথে সাথে সব কিছু করে দিত ধৈর্য ধরে। বড়কাকার হাতের-লেখা ব্যাপারটা আরেকটা প্যাশনের জায়গা
ছিল। আমাকেও ওই বিশেষ রকমের পেন এনে লেখা প্র্যাকটিস করিয়েছে অনেক, যেটায় একটা এঙ্গেল
থেকে ধরলে মোটা করে লাইন হয় আর অন্য এঙ্গেল থেকে ধরলে সরু রেখা পড়ে। ‘এস’, ‘টি, ‘আই’
বা ‘জে’ লেটারগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম ভাবে লিখত বড়কাকা, কোথা থেকে শিখেছিল সেটা ভাবি
এখন। (বিশেষ দ্রষ্টব্য – এগুলো যেসময়ের কথা, তখন মাইক্রোসফটওয়ার্ড আবিষ্কার হলেও আমাদের
জগত অবধি পৌঁছতে অন্তত আরও এক দশকের অপেক্ষা।) আর বাংলা ফন্টে লেখার ব্যাপারেও বড়কাকার
একই রকমের আগ্রহ ছিল। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপি নকল করে বাংলা লেখা প্র্যাকটিস করতে
দেখেছি মাঝেমাঝে। রবীন্দ্রনাথের সই-টা আমাকেও শিখিয়ে দিয়েছিল, যাতে একবারও পেন না তুলে পুরো নাম-টা লেখা যায়। এবারে গিয়ে খেয়াল করলাম, বড়কাকার পড়ার ঘরে ডানদিকের দেওয়ালে কোনায় যে ছবিটা টাঙ্গানো আছে রবীন্দ্রনাথের,
সেটার নিচে ওই সইটা করে রেখেছে বড়কাকা।
তবে “এভরিথিং নাইস” এর সাথে
“সুগার এন্ড স্পাইস”-টাও বলা দরকার, নাহলে পক্ষপাতিত্ব হয়ে যাবে। বড়কাকা কিন্তু ছোটবেলায় আমাদেরকে বেশ খ্যাপাত। প্রতিবার পুজোর আগে একবার আমাকে ডেকে বলত – “এ বাবা, তোর মোটে চারটে
জামা হয়েছে? বুড়ির তো আটটা!” আর ওদিকে পরমুহূর্তেই বুড়িদিকে ডেকে বলত – “ এমা বুড়ি, তোর মাত্র পাঁচটা জামা হয়েছে বুঝি?
টুয়ার তো এদিকে দশটা বারোটা হয়ে গেলো!” বলাই বাহুল্য,
নিজেদের বাড়িতে গিয়ে আমি বা বুড়িদিদি একথাটা বললেই দুইবাড়ির লোকই একি
উত্তর দিত, যে – “ঠিক আছে, বাকিগুলো বড়কাকাকেই কিনে দিতে বল!” আর একবার,
বিট্টু গেছে বড়কাকা আর কাকিম্বাবার সাথে পুজোর বাজার করতে। তা ওরা সবার জন্য কেনাকাটা করছে, আর বিট্টুকে বোধহয় বেশ কয়েকবার
সেধেছে কিছু কেনার জন্য, বিট্টু কেনেনি। তারপর সবশেষে ফেরার সময় যখন বাটার দোকানের পাশ দিয়ে আসছে, তখন বিট্টূ
আর থাকতে না পেরে বলে – “আমার বাবা-মা না
আমাকে জামা প্যান্ট সবই কিনে দিয়েছে, কিন্তু তারপর কি যে হল,
জুতো কিনতে গিয়েই সব টাকা ফুরিয়ে গেলো। তাই জুতোটা আর কেনা হলনা!” তারপর ইয়া বড় ব্যাগে করে নুতন জুতো জোড়া নিয়ে সগর্বে বাড়ি ফেরা।
বড়কাকার বাড়ি থেকে খালি
হাতে ফিরতাম না বিশেষ। বিট্টু তো সবসময় ফিরত আম হাতে করে, আর আমি এই সেদিন অবধিও অনেক আড্ডা টাড্ডা মেরে বাড়ি
ফেরার সময় চারদিকে চোখ বুলিয়ে কোন একটা বই পছন্দ করে বাড়ি নিয়ে আসতাম, আর তারপর
সেটা শেষ করে ফেরত দিয়ে আবার আরেকটা। অদ্ভুত লাগে যে, কি করে জানিনা, এই স্বভাবটা এত
বছরের ফারাকে আমার কন্যার মধ্যেও হুবহু বর্তেছে। মাঝেমাঝে তো সে একাই হাঁটা লাগায়
ওদের বাড়িতে – “কোথায় যাচ্ছিস?” জিজ্ঞেস করলে গম্ভীর হয়ে বলে, “বড়কাকার সাথে গল্প
করতে যাচ্ছি।“ আর কিছুক্ষণ পরেই দুহাতে দুখানা বড় বড় আম নিয়ে
পত্রপাঠ বাড়ি। এসে বলে, বড়কাকা নাকি জোর করে দিয়ে দিল। জেনেটিক দোষ - যাবে কোথায়!
আমার নাম টুয়া; তাই বড়কাকা আমার মেয়েকে “ছোট্টুয়া” বলে
ডাকতো।
(৬)
একটা ব্যাপার
ক্ল্যারিফাই করা দরকার -
তখনকার সময়ে শুধু যে আমরা বাচ্চারা মিলেই আনন্দ করতাম, তা কিন্তু মোটেই নয়;
বড়রাও বেশ এঞ্জয় করত। যেরকম, মাঝে একটা সময় একটা নতুন ব্যপার শুরু
হল বড়দের মধ্যে – প্রথমে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই, আর তারপর রীতিমতন অরগানাইজডভাবে,
বড়কাকার উদ্যোগে। সেটা হল – বিয়েবাড়িতে মাছ আর রসগোল্লা খাওয়ার কম্পিটিশন! তবে এটা
বলার আগে একটু ভুমিকা করে নেওয়া দরকার...
আমাদের বাড়ির গলিটা
আসলে একটা ব্লাইন্ড লেন, আর তার
মধ্যে সাকুল্যে চারটে বাড়ি। এই চারটে বাড়ি
একে অপরের নিকটাত্মীয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হয়না। এই আমাদের ইমিডিয়েট পাড়া। তা, এই পাড়ার যে কোন বিয়েতেই এই চারটে বাড়ির দায়িত্ব যেভাবে ভাগাভাগি করা থাকত যে বাইরের
কারোর পক্ষে নেমন্তন্নর কার্ড না দেখে গেস করা সহজ হতনা
যে বিয়েটা এর মধ্যে কোন বাড়ির ছেলের বা মেয়ের। আমাদের বাড়িতেমেয়ে বসত। আর ওই পিছনের বাঁধানো জায়গাটা, যেখানে লুকোচুরি খেলা ছাড়া আর কিছু হতনা আদারওয়াইজ,
সেখানে বড় বড় উনোন বসিয়ে রাঁধুনি দিয়ে রান্না হতো। ওদের বাড়িতে ওই নিচের ঘরটায় মেঝেতে ফরাস পেতে বর বসানো হতো, আর বাইরে অতিথিদের জন্য সারি দিয়ে চেয়ার। আর দুটো বাড়ি - বুড়িদিদের বাড়ি আর চন্ডি জেঠুর বাড়ি - মেইনলি গেস্ট হাউজ হিসেবে
ব্যবহার হতো (শুনতে সেকেন্ডারি লাগলেও ওই দায়িত্বটাই সব চেয়ে
কঠিন এবং লম্বা, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই!)। আর গলির মুখেই বড় করে গেট এবং সেখান থেকে চতুর্থ বাড়িটা অবধি
টানা প্যান্ডেল হতো। লাইন করে বেঞ্চ-চেয়ার পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা ওখানে।
তা সেবার, বোধ হয় কণাপুসুর বিয়েতেই হবে, আমার বাবা, কাকামনি, বড়কাকার কয়েকজন
বন্ধুরা আর ছাত্ররা, এরকম বেশ কয়েকজন মিলে খেতে বসে “
এই, আপনি ক’টা মাছ খেলেন?”
“আমি আপনার চেয়েও দুটো বেশি!” এসব বলে টলে নিজেদের
মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। একটা সময়ের পর ব্যাপারটা জাস্ট জমে গেল! বড়কাকা কোনদিনই নিজে একেবারেই খাইয়ে টাইপের
নয়, ইন ফ্যাক্ট জলটা পর্যন্ত পরিমাণ মেপে, ঘড়ির কাটা ধরে খেত। কিন্তু খাওয়াতে
আর খাওয়ায় ইন্সপিরেশন দিতে খুব ভালবাসে তো বটেই, আর তাছাড়া এইসব কম্পিটিশনের আগুনে ঘি ঢালতে বড়কাকার জুড়ি নেই!
এই ঘটনার পর পরই
বুড়োকাকার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হল। তা বুড়োকাকার বিয়ের সময় বোধ হয় প্রাথমিক
কথাবার্তার সময়ের বড়কাকা কাকিনের বাড়িতে কথাটা পেড়ে রেখেছিল, যে – “আমাদের বাড়ির কিছু লোকজন কিন্তু একটু বেশি
খাবে!” আর এটাও মনে
আছে, বাবা বড়কাকাকে পরে জিজ্ঞেস করে কনফার্মও করেছিল – “আমরা
যে কম্পিটিশন করব সেটা ওদেরকে বলে রেখেছেন তো?” বোধ হয় ওদের টেবিলের এর জন্য দু চারটে কেটারিঙের ছেলেকে ডেডিকেটেড-ভাবে সার্ভ
করতে বলে রাখা হয়েছিল। আর বড়কাকা প্রতিযোগীদের উৎসাহ দিতে ফার্স্ট প্রাইজও
অ্যানাউন্স করে দিল – একটা শার্টের পিস আর একটা প্যান্টের পিস! এক একজন বোধ হয়
চব্বিশটা ছাব্বিশটা করে মাছের পীস খেয়েছিল, আর বেশ অনেকগুলো করে রসগোল্লা। যতদূর
মনে পড়ছে, অরুণ রাহা কাকু – বোধ হয় উনিই জিতেছিলেন! আর বিট্টূ তখন বেশ ছোট, ন বছর
বয়স; আর তাই বড়কাকা ওকে টার্গেট দিয়েছিল – ন’টা রসগোল্লা খেতে হবে। বিট্টূ এক একটা কামড় কোনোমতে জল দিয়ে গিলে খাচ্ছে,
আর বাবাকে ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করছেঃ “ন’তা হতে আর কতা বাকি, বাবা?”
কুটুপুসুর বিয়েতেও একই
রকমের কন্টেস্ট হয়েছিল, আর এবারে
প্রতিযোগী হিসেবে আর জয়েন করেছিল বুড়োকাকার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, অর্থাৎ কাকিনের বাবা আর কাকু।
এই খাওয়ার কালচারটা কালীপূজোর
পরেরদিন দুপুরের ভোজেও বড়কাকা খুব প্রোমোট করার চেষ্টা করত। তবে আস্তে আস্তে সবার বয়েস হয়ে যাওয়ায় ইদানীংকালে বড়কাকার মনের মতন খাইয়ে লোকজন আর খুব বিশেষ সেরকম পাওয়া
যেত না বোধ হয়।
(৭)
বড়কাকা কোনোদিনই একেবারেই হিসেবের বাইরে খাওয়াদাওয়া করত না, সেটা তো আগেই বলেছি।
আর খাবারের ব্যাপারে খুব চুজিও। কিন্তু যখনই খাবারদাবারের বিষয়ে গল্প হত, বড়কাকা টেনিদা
স্টাইলে – না, আস্ত পাঁঠা না, কিন্তু আস্ত কাঁঠাল খাওয়ার গল্প করত খুব গর্ব করে। অনেকবারই
বলেছে যে বাংলাদেশে বড়কাকাদের বাড়িতে, তখন যেরকম হত আর কি, প্রচুর নানারকমের ফলের গাছ
ছিল। বাড়ির পিছনদিকে নাকি একটা ছোটখাটো স্টোররুম ছিল যাতে শুধু ফল রাখা হত। আর বড়কাকা
নাকি পাঠশালা থেকে ফিরে এসে সোজা ওই ঘরে গিয়ে আস্ত কাঁঠাল ভেঙ্গে পুরোটা খেয়ে নিত।
কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার কেন জানি না এই কথাটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য লাগেনি কোনোদিনই!
বড়কাকা মাঝেমাঝেই বাংলাদেশের অনেক গল্প বলত, প্রসঙ্গ উঠলেই। বড়কাকার বাবা বড়কাকাকে বেশ কম বয়েসেই কলকাতায় পাঠিয়ে
দিয়েছিলেন পড়াশোনার জন্য, ওনার বন্ধুর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
গ্রামের ছেলের প্রথম শহরে আসা, এখানে একটা এত বড় শহরে একা থাকা, কলেজে পড়া, একটা
সীমিত হাত খরচায় টেনেটুনে মাস চালানো, ট্যুইশন করা... ঠিক যেন একটা “অপরাজিত” বা
“কালবেলা”-র গল্প, অন্তত প্রথমদিকটা! আর ঠিক তারপরেই সেই ভয়াবহ উথালপাথালের সময় – যতবার
শুনেছি আশ্চর্য হয়েছি, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গত বছর, দিদা চলে যাওয়ার দু একদিনের
মাথাতেই, আমি ওইসময়টা কলকাতায় ছিলাম। একদিন বেশ অনেক্ষণ ধরে বড়কাকার কাছে বসে
সেইসব গল্প শুনছিলাম আমি, দিদাকে নিয়ে লিখবো বলে। আবার, বড়কাকা চলে যাওয়ার পর ওদের
বাড়িতে বড়পুসুর কাছে বসে ঠিক একইভাবে আবার সেই বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠল... আরও সব গল্প। বড়কাকা যখন কলকাতায় বসে খবর
পাচ্ছে যুদ্ধের, সেইসময় কার কাছে একটা মুখে মুখে খবর পেল, যে মা আর ভাই বোনেরা নাকি
চলে এসেছে দেশ ছেড়ে, কোথাও কোন একটা রিফিউজি ক্যাম্পে আছে। দিদা তখন সাত দিন সাত
রাত হেঁটে বর্ডার ক্রস করে এসেছে, সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে – সবাই যে প্রাণে
বেঁচে আছে, সেটাই তখন অনেক। যা শুনেছি, কুটুপুসু বোধহয় ছ’ মাসের, বাকিরা জাস্ট
একটু একটু বড় তার থেকে। বড়কাকা খবর পেয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দু’দিন তিনদিন গিয়ে
খুঁজে এলো, কোথাও পেলো না ওদের, খালি হাতে ফিরে এলো। আর তারপর, একদিন আবার পেলোও। তখনও নাকি দিদা বা বড়কাকা কেউই জানেনা যে বড়কাকার বাবা বেঁচে আছেন কিনা – বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে সেই যে
গেছে, আর নাকি খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেক পরে অবশ্য খোঁজখবর করে জানা গেছে সবই। তারপর
পরিস্থিতি একটু শান্ত হওয়ার পর দিদারা আবার ফিরে গেলো, বড়কাকাই সঙ্গে করে নিয়ে
গেলো। গিয়ে দেখে, দরজা জানলা সব খুলে নিয়ে, ভেঙ্গে নিয়ে চলে
গেছে; সব ঠিকঠাক করে সারিয়ে টারিয়ে বড়কাকা আবার কলকাতায়
ফিরল। কিছুদিন কাটানোর পর একটু ব্যবস্থা করে নিয়ে আবার দেশে
গিয়ে এবারে ওদের সবাইকে নিয়ে এলো পশ্চিমবঙ্গে। তারপর মধ্যমগ্রাম আসা – প্রথমে
ভাড়াবাড়ি, তারপর জমি কিনে একটা ঘর তোলা...
বড়কাকার বইয়ের র্যাকে
খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তাক জুড়ে বেশ কিছু পারটিশনের ওপর লেখা বই – সাহিত্যধর্মী
বা রাজনৈতিক, দু’ প্রকারেরই। সেখানে “কেয়াপাতার নৌকা” যেমন আছে, তেমন “জিন্না”-ও।
এই ছোট্ট অবজারভেশনটা থেকেই বোঝা যায় যে
বড়কাকা কি ভীষণ একটা অতিমানবীয় ক্ষমতা রাখত! সাইকলজিকাল
থেরাপিতে একটা শব্দ শুনেছি খুব প্রচলিত, তার নাম “ট্রিগারিং”; সবারই নাকি হয়, কম বা
বেশি। আর আমি ভাবি, এত বড় একটা ব্যাক্তিগত ক্ষতর জায়গাটা থেকেও কিন্তু
বড়কাকা নিজেকে ঠিক উত্তরণ করে নিয়ে গেছে - এই পারটিশন, দাঙ্গা, রাজনৈতিক
এবং ধর্মীয় খুনোখুনির প্রসঙ্গটার প্রতিও একটা
নৈরব্যাক্তিক অ্যাকাডেমিক ইন্টারেস্ট, অব্জেচটিভ ভিউপয়েন্ট, ফ্যাকচুয়াল এভিডেনসিয়াল
স্টাডি করার মানসিকতা বজায় রেখে গেছে। এই ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে আর পাঁচজন সাধারণ
মানুষের ক্ষমতার বাইরে!
আরও একটা ব্যাপার
হল, এত গল্প যে বলত বড়কাকা, একবারও কিন্তু ঘুণাক্ষরেও নিজের অ্যাকাডেমিক বা পার্সোনাল স্যাক্রিফাইসের কথা
উল্লেখমাত্র করত না। বলত না যে, যে পড়াশোনার ক্ষেত্রে গোল্ড-মেডেল আর স্কলারশিপ
ছাড়া আরও যেসব সুযোগগুলো এসেছিল কিন্তু নিতে পারেনি, সেগুলো নিতে পারলে আজ কি কি
হত, কোথায় পৌঁছনো যেত। কখনই বলতনা এগুলো, বরং জিজ্ঞেস করলে বলত – “আরে, ওই সময়টাই ওরকম ছিল!”
(৮)
আমাদের ছোটবেলার
সময়টাও, সত্যি বলতে কি, অন্যরকমেরই ছিল – আজকাল দেখে চেনা যায়না, নিজের কানেই গল্প
বলে মনে হয়। সেইসময় আমাদের প্রাতরাশ মানেই আঁকশি দিয়ে গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে পাঁচিলে বসে খাওয়া, বিকেল মানেই এপাড়া ওপাড়া
ঘুরে নানারকম ফুল সংগ্রহ, অর্থাৎ চুরি, করে আনা, ইত্যাদি। আমাদের কুকুর বেড়াল যাই
পোষা হত, সেটা কোন একটা বাড়ির সম্পত্তি হত না, পুরো পাড়াটাই তার বাড়ি। এরকম করেই
কোথা থেকে একটা কুকুরছানা আনা হল, তার নাম দেওয়া হল গুড্ডু। সে বড় হওয়ার পর তার
জিওমেট্রিক প্রগ্রেশনে বাড়তে থাকা পরিবারের দায় নিতে গিয়ে আমাদের পড়াশনা এমনকি
নাওয়াখাওয়াও মাথায় উঠল। তাই একটা পয়েন্টের পর খুব মন শক্ত করে আমরা তার পরিবারবর্গকে
এর বাড়ি তার বাড়ি অ্যাডপশনের জন্য পাঠালাম। তারপর আমাদের প্রতিদিন বিকেলের
হাঁটাহাঁটি মানেই হত পাড়া ঘুরে ঘুরে সব কটা বাচ্চাকে তাদের অ্যাডপ্টিভ হোমে ভিজিট
করতে যাওয়া। এরপর অনেকদিন কুকুর পোষা বন্ধ ছিল, সেই নিয়ম আবার ভাঙলো বহুবছর পরে,
যখন একটা রুগ্ন ছোট্ট কুকুরের বাচ্চা কোথা থেকে জানিনা
আমাদের পাড়ায় এসে নিজে থেকেই আশ্রয় নিল। সেটা খুবই ওয়েল-বিহেভড আর টিমিড টাইপের কুকুর ছিল, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত না, পেলে খেত
আর না পেলে উপোষ করত; তাই বড়কাকা ওর নাম দিল – “পেলে খাই”। আমরা ডাকতাম ‘পেলে’ বলে। তারপর একবার বোধ হয় কালিঠাকুর রঙ করার সময় রঙ বেঁচে যাওয়ায় বড়কাকা কালো রঙ দিয়ে ওর সাদা লোমের ওপর বড় বড় করে লিখে দিল - পি কে!
আজকাল দেখলে আমাদের
পাড়াটা আর জাস্ট চেনা যায়না। স্রেফ বাড়িগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সময়টা
যেন সব আনন্দ আর উৎসবগুলোকে পিছনে ফেলে এসেছে অনেকটাই; স্মৃতিগুলোও সব পিছিয়ে
পড়েছে তার সাথে। নারকেলগাছ, পেয়ারাগাছ গুলো বেশিরভাগই কাটা পড়ে গেছে, দু একটা
আমগাছ আর সুপুরিগাছ টিম টিম করে জ্বলছে; আর বড়কাকার হাতে করে লাগানো পাতাবাহার
গাছের সারি! মানুষজনও প্রায় নেই বললেই চলে
– বাড়িগুলোর অধিকাংশ ঘরই ফাঁকা পড়ে থাকে, একদিন বৃদ্ধাশ্রম মনে হয় যেন। আর বিশেষ করে
ওদের বাড়িটা যে এক সময়ে ঠিক কিরকম ছিল,
সেটা এখন শত কল্পনাতেও ধারণা করা যাবে না আর।
এখন বহুবছর হয়ে গেলো
কর্মসুত্রে কলকাতার বাইরে থাকি। বড়কাকার রিটায়ারমেন্টের পর কাজের চাপও নেই। তাই
আজকাল যখন বাড়ি যেতাম, এই ফাঁকা মাঠের বাজারে বেশ নিরবিচ্ছিন্ন আড্ডা জমত আমার,
কাকিম্বাবার আর বড়কাকার। যত রাজ্যের অ্যানালিটিকাল, মাইথলজিকাল, রাবিন্দ্রিক,
আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক ও নানা প্রকারের এদিক ওদিক –পৃথিবীর এবং মহাকাশের
প্রায় যেকোনো বিষয় নিয়ে শুরু হত আড্ডা, আর আর অনেক যেকোনো বিষয় ঘুরে অবশেষে আবার একটা অন্য কোন যেকোনো বিষয় নিয়ে চলতে থাকত, চলতেই থাকত যতক্ষণ না মা বা বাবা হাঁক
পাড়ত এক্ষুনি বাড়ি আসার জন্য।
তবে রিটায়ারমেন্টের
কিছু বছর আগ দিয়ে বড়কাকার নতুন যে জ্বরটা হল, এবং বেশ সাঙ্ঘাতিক ভাবে হল, সেটার
নাম ইন্টারনেট! ইন্টারনেট জ্বর এমনিতেই
অবশ্য স্বনামে খ্যাত, সাইকলজি থেকে ক্রিমিনলজি সব জায়গাতেই যে এই রোগটার প্রচুর দাপট
তা আমরা সবাই জানি। এবং বড়কাকার সঙ্গে আমাদের বা ভবিষ্যতের কোন জেনারেশনেরই বোধ করি
আর যাই তফাৎ থাকুক জেনেরেশন গ্যাপ নামক বস্তুটা কোনদিনই দাঁত বসাতে পারবেনা এটাও ঠিক।
কিন্তু তাই বলে বড়কাকার সোশ্যাল এবং আনসোশ্যাল মিডিয়ায় অষ্টপ্রহর অবাধ বিচরণ আমাদের কাছে সত্যি বলতে কি সামান্য চিন্তার
কারণ হয়েই দাঁড়ালো একটা সময়ের পরে। যেমন, একবার গিয়ে দেখি খুব সুন্দরী একজন মহিলার
ছবি বড়কাকার ওয়ালপেপারে সেট করা। বোধকরি মডেল, আর বলাই বাহুল্য, তার পোশাক পরিচ্ছদও
মডেলের মতনই। বড়কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এ কে?” বড়কাকা অম্লানবদনে বলল – না, অম্লানবদন
বললে ভুল হবে, বরং বেশ গর্ব করেই বলল – “ইন্টারনেটে পেয়েছি, ভাল লাগলো বলে ডাউনলোড
করে ওয়ালপেপার করে সেট করে রেখেছি!”
এরপরে আর সত্যিই…
(৯)
বড়কাকার যে কোন বিষয়েই লেটেস্ট মডেল
– আই মীন, কম্পিউটারের মডেল – বেরোলেই ঝটপট কিনে ফেলত। এমনকি, দেশে আসেনি এমন সব গ্যাজেটও
অনেকগুণ বেশি দাম দিয়ে ইম্পোরটেড ভারসান কিনে ফেলত। এবং সেটায় আর কিছু না হোক, আর কিছু
করতে পারুক না পারুক, “পেন্ট” সফটওয়্যার আর গুগ্ল-এর পেজটা, এবং ইদানীংকালে জিমেল আর
ফেসবুক প্রভৃতি, খুব মনোযোগ সহকারে দিনমান ব্যবহার করে যেত। কিরকম ব্যবহার? ধরা যাক
আমি ফেসবুকে কোন একটা ছবি পোস্ট করলাম। এবারে অনতিকাল পরেই দেখব, আমার মেলবক্সে একটা
মেল, ফ্রম অরুণ কুমার বসু। সেটায় আবার আমাকে সি-সি করে বিটটুকে মেল করা। তবে শুধু ইমেল
নয়, সাথে আবার অ্যাটাচমেন্ট – যদিও সাব্জেক্ট বা বডি পুরোই তেপান্তরের মাঠ। এবারে সেই
অ্যাটাচমেন্ট খুললে দেখব, আমারই ছবিটা কে ডাউনলোড করে সেটার ওপরে “পেন্ট” এর সাহায্যে
কারিকুরি করা হয়েছে কিছু একটা। যেমন একটা উদাহরণ নিচে দিলামঃ
বোঝাই যাচ্ছে, যে বক্তব্যটা হল –
আমি ফেসবুক পারি, ডাউনলোড পারি, পেন্ট পারি, আপলোড পারি, এবং ইমেলও
করতে পারি।
বড়কাকার ইন্টারনেট
শক্তির আরও একটা ব্যাপার আছে। কোন বিষয়ে তর্কের বাজার গরম হতে হতে একটা পয়েন্টে
এসেই যায়, যে – “তুমি এটা পড়েছ? ভারসাস “তুই এটা পড়েছিস?” এরকমই একবার - সেবারে
আমি আর বিট্টু দুজনেই ছিলাম – চিল্ড্রেন লিটারেচার নিয়ে কোন একটা আলোচনার প্রসঙ্গে
ফাইনালি এসে দাঁড়ালো, যে – “বড়কাকা, তুমি যে এটা বলছ, তুমি হ্যারি পটার পড়েছ?” মানে, কোমলভাবে মোটেই নয়, চ্যালেঞ্জের সুরেই। এইসবের উত্তরে আগে হলে
বড়কাকা একটু দমে যেত, বড়জোর একটু মৃদু গলায় বলত যে “নাই বা
পড়ি, সিনেমাগুলো তো দেখেছি”... কিন্তু সেবারে খুব দাপটের
সাথে উত্তর দিলো, কম্পিউটারের দিকে আঙ্গুল পয়েন্ট করে – “এর মধ্যে তো আছে!” যার
মানেটা দাঁড়ায় যে, আমার অবারিত ইন্টারনেট কানেকশন আছে, অর্থাৎ আমার চব্বিশ ঘন্টা
গুগল অ্যাক্সেস আছে, অর্থাৎ গুগল বা উইকিপেডিয়ায় যা যা জ্ঞান আছে তা আমার কণ্ঠস্থ বা মুখস্থ না থাকলেও আমার
হাতের আস্তিনের ফাঁকেই তাসের মতন গোঁজা আছে! ওই যে আইন্সটাইনের একটা কোট আছে না,
যে “Intelligence is not the ability to store
information, but to know where to find it.” – ব্যাপারটা
সেরকমই!
(১০)
আরো
একটা দিনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
এই লাস্ট ডিসেম্বরে যখন কলকাতা গেলাম, একদিন বড়কাকার টেবিলের একদিকে আমি অন্যদিকে কাকিম্বাবা বসে তিনজনে এক বিষয় থেকে অন্য বিষয় এমনিই গল্প করছিলাম।
তারপর আলোচনার মোড় ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে ঠেকল মহাভারতে! কয়েকবছর আগে আমরা কয়েকজন ব্লগাররা মিলে
একটা আলাদা ওয়েবপেজ খুলে মহাভারত নিয়ে নিজেদের মতন করে ইন্টারপ্রেট করে লিখতে শুরু
করেছিলাম; এক একটা আরটিকালে এক একটা চরিত্রকে ইম্পারসোনেট করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে ন্যারেশন করছিলাম। তারপর যেমন হয় আর কি, কিছুদিন পড়ে সবাই উৎসাহ হারিয়ে
ফেলেছিলাম। তা, বড়কাকাকে বলায় বড়কাকা তো
খুবই আগ্রহ দেখাল। আমার দু’ একটা লেখা পড়তে দিলাম। নানান পারস্পেক্টিভ থেকে
আলোচনা হল – গজেন মিত্র থেকে নৃসিংহ ভাদুরি থেকে চিত্রা দিভাকারুনি থেকে আদি,
অকৃত্রিম রাজশেখর বসু থেকে উপেন্দ্রকিশোরের “ছেলেদের মহাভারত” – নানা মুনি, অর্থাৎ লেখক, তাদের নানা মত! কথায়
কথায় প্রশ্নটা এসে ঠেকল, যে – মহাভারতের “নায়ক” তাহলে কে?
পপুলার বিশ্বাস থেকে
এটাই প্রচলিত যে কৃষ্ণই হচ্ছে আসল মাস্টারমাইন্ড – “পাঞ্চজন্য” সেই ভাবনার গোড়ায় ঘি জোগান দেয় অকৃপণ! কিন্তু সেই
ইনফ্লুয়েন্স থেকে যদি বেরনো যায়... আমি বললাম, কুন্তীর ভুমিকাটা সবাই ওভারলুক করে
যায় কিন্তু কুন্তীর অ্যাম্বিশন কিন্তু বহু অংশেই কুরুক্ষেত্রর জন্য দায়ী। আর, বহু
রিসার্চবেসড লেখাতেই কিন্তু এটা বলা আছে যে বিদূরই নামান্তরে ধর্ম, অর্থাৎ
যুধিষ্ঠিরের পিতা। সেখানে যৌথ অ্যাস্পিরেশনের অ্যাঙ্গেলটা বাদ দেওয়া যায়না। আবার অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে
গান্ধাররাজ আর তার শতপুত্রের অনাহার-মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসেবেও কুরুবংশ ধ্বংস
শকুনির উদ্দেশ্য ছিল, যে কারণে বাবার পাঁজরের হাড় দিয়ে পাশা বানানো। বড়কাকা বলল, “যুদ্ধের উদ্দেশ্য বা পরিণতি আলাদা ব্যাপার, কিন্তু ইন্ডিভিজুয়াল ব্যাক্তি
হিসেবে “হিরো” বা প্রোটাগনিস্ট কাকে বলা যায়?” কঠিন প্রশ্ন!
গ্ল্যামরের দিক থেকে ভাবলে শৌর্যে বীর্যে অর্জুন , বুদ্ধির দিন থেকে কৃষ্ণ বা
শকুনি, এদিকে বঞ্চনা, ত্যাগ বা দানের দিক থেকে দেখলে কর্ণ, উইসডম বা
পারসোনালিটির দিক থেকে ভীষ্ম... আবার এদিকে দ্রৌপদীর অপমানের প্রতিবাদ, প্রতিকার
বা প্রতিশোধের বেলায় কেউ আসেনি, এক ভীম ছাড়া। আমার ধারণা ছিল বড়কাকার দিক থেকে
নমিনেশন আসবে ভীষ্ম, বা বড়জোর গান্ধারী! কিন্তু আমাকে বেশ অবাক করে দিয়ে বড়কাকা
হঠাৎ যুধিষ্ঠিরকে খুব মহিমান্বিত করে
এক্সপ্লেন করতে লাগলো। আমি প্রতিবাদ করতে করতেই বড়কাকার বইয়ের তাক থেকেই লাল মলাটের রাজশেখর বসুর বইটা নিয়ে আসলাম, প্রমাণস্বরূপ। বললাম
– এমনিতেই জুয়াড়ি তো বটেই, দায়িত্বজ্ঞ্যনহীন ভাবে একবার নয়, দু’বার সম্পত্তি
হারিয়েছে, ইত্যাদি। প্লাস এই কুরুক্ষেত্রেরে যুদ্ধের সিনগুলো পড়ো, দেখবে – ওই
ভাইরা পালা করে ওর রথকে ঘরে পাহারা দিচ্ছে পাছে ওকে না কেউ মেরে দেয়। যুধিষ্ঠির
মারা পড়লেই তো যুদ্ধ শেষ, আর ও অ্যাটাক তো ছাড়ো, সেলফ
ডিফেন্সটাও ঠিক করে করতে পারেনা। অথচ, সিংহাসনের লোভ কিন্তু
ষোলোয়ানা! যুধিষ্ঠির না ক্ষত্রিয় না ব্রাহ্মণ! যে স্বধর্ম পালনের জন্য দুর্যোধন
পর্যন্ত (মৃত্যুর পরে) স্বর্গে গেলো, সেখানে যুধিষ্ঠির তো নিজের স্বধর্ম স্থিরই
করতে পারলনা! বড়কাকা তখন একটা অদ্ভুত যুক্তি দিল; বলল – এই যে মানব চরিত্রের
সাধারণ দুর্বলতা, এটাই তো মানুষ হিসেবে স্বধর্ম, ল্য অফ নেচার। ওর নানান চারিত্রিক
সবলতা আর দুর্বলতাকে ধারণ করেই ওর যে প্রজ্ঞা আর অবিচলতা, সেটাই ওর চরিত্রের
সার্থকতা। মহাভারতের এই জন্মটা, এই লাইফটাইমটাই যুধিষ্ঠিরের শেষ মানব জন্ম, কারণ ও
তারপর সশরীরে স্বর্গে গেছিল। এই যে ও কোয়ালিফাই করল, এই পরিণতিটাই প্রমাণ যে ওর এই
যুধিষ্ঠির হিসেবে মানবজন্মটা সার্থক। এটা জন্মান্তরের লজিক মেনে নিলে একপ্রকারের
ফার্স্ট প্রাইজ! গ্ল্যামর, ত্যাগ, অস্ত্র
বা শাস্ত্র বিষয়ক পারদর্শিতা, বা ইভন চারিত্রিক সবলতা বা দুর্বলতা – এর মধ্যে কোন
একটা দিয়ে একটা মানবজন্মকে পুরোপুরি বিচার করা যায়না, অন্তত কাহিনীকার অর্থাৎ
ব্যাসদেব সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। উনি যেটা হাইলাইট হয়ত করতে চেয়েছেন সেটা হল –
ট্যালেন্ট বা অন্যান্য দোষগুণ ঠিক আছে, কিন্তু একটা মানবজন্ম থেকে তুমি কতটা
শিখলে? যে পরীক্ষাটা অজ্ঞাতবাসের শেষে যুধিষ্ঠির যক্ষকে দিল। বাকি ভাইদের প্রাণ
বাঁচানোটা কিন্তু লক্ষ্য নয়, ওই এপিসোডটার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু এই যে যুধিষ্ঠিরের
ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ হয়েছে, আর এই প্রশ্নোত্তরের পর্বটা ওর পরীক্ষা যেটায় ও
প্রত্যেকটা উত্তর সঠিক দিতে পারল, উত্তীর্ণ হয়ে গেলো। এই প্রসঙ্গে বড়কাকা আমাকে
একটা চটি বই পড়তে দিল, বুদ্ধদেব বসুর “মহাভারতের কথা”। গোগ্রাসে শেষ করলাম বইটা,
তারপর আরেক দফা আলোচনা হল। এই বইটার ভিত্তিতে যে কথাটা বড়কাকা আমাকে খুব প্রাঞ্জল
করে বোঝাল সেটা এই যে – আমরা যখন কারোর দিকে তাকাই, তার বিচার করি, তখন তো সেটা
একান্তভাবে নিজেদের দৃষ্টি দিয়েই তাকাই। সার্বিকভাবে তো কাউকে দেখিনা, আর আমাদের
সেই ক্ষমতাও নেই। আমরা সবাই কালারড গ্লাস নিয়ে বাঁচি! যেভাবে অর্জুনকে ধনুর্ধর
হিসেবে দেখি, কর্ণকে ওর ত্যাগ দিয়ে দেখি, ভীষ্মকে ওর উইজডম দিয়ে। কিন্তু, কোনটা
ঠিক, ঠিক কোন ইয়ারডস্টিক-টা দিয়ে একজনকে পুরোপুরি বোঝা যাবে?
এবারে – ওই বইটার আর সাথে বড়কাকার বক্তব্য অনুযায়ী - সম্যকভাবে
সেই মানুষটাই শ্রেষ্ঠ, যে দোষে গুনে সবলতায় দুর্বলতায় সবদিক থেকে তুলনামুলক ভাবে
সাধারণ হলেও যে, এক – “যুদ্ধে স্থির” অর্থাৎ বিচলিত হয়না, পরিস্থিতি নির্বিচারে
নিরপেক্ষ, ব্যালেন্সড এবং গ্রাউন্ডেড, আর দুই -
ক্রমাগতভাবে, নিরন্তরভাবে সে অনুসন্ধানী, জিজ্ঞাসু। অর্থাৎ তর্কের খাতিরে
যদি জন্মান্তর মেনে নেওয়া যায়, তাহলে একটা মানবজন্ম তো সেই বৃহত্তর ডিজাইনে সিঁড়ির
একটা ধাপ মাত্র, এবং সেটাকে ট্রেনিং পিরিয়ড হিসেবে ব্যবহার করে সেই জন্ম থেকে যতটা
পারা যায় ততটা শিখে, জ্ঞান সঞ্চয় করে বেরনোটাই উদ্দেশ্য!
সেবার কলকাতা থেকে ফিরে এসে এই কথাটা আমাকে খুব ভাবিয়েছিল। আর তারপর কোথাও
একটা এই কোট-টা নজরে পড়ে -
“We are not human beings having a spiritual experience.
We are spiritual beings having a human experience.” - Pierre Teilhard de Chardin
আমাদের
নানান অভিজ্ঞতাকে এভাবে দেখতে পারলে কিন্তু আমাদের
সবার অতি সাধারণ জীবনের অতি সাধারণ অনেক প্রশ্নের উত্তরই খুব সহজে খুঁজে পাওয়া
যায়, অনেক সঙ্কীর্ণতার অলিগলি পেরিয়ে হয়ত আরেকটু অন্যভাবে, আরেকটু বড় করে ভাবা
যায়, চেষ্টা করা যায়। সেদিন সকালে আমাদের এই আড্ডায় মহাভারত যেন একটা মহাকাব্য
থেকে একটা জীবনবোধে উত্তীর্ণ হয়ে গেছিলো!
(১১)
বড়কাকার একটা মস্ত ব্যাপার
হল যে বড়কাকা যেন কখনই কোন পক্ষ নিয়ে কথা বলত না, সমর্থন বা অসমর্থন করতো না - সেটা
কোন চরিত্রই হোক বা কোন থিয়োরি, বা কোন ব্যাক্তি। বড়কাকা সব কটা প্যসিবিলিটিকে, বা
যেকোনো ডিবেটের দুটো দিককেই, তাদের মেরিট আর ডিমেরিট দিয়ে যাচিয়ে দেখতে জানত। আর, সহজে
কোন কনক্লুশনও ড্র করত না, উপসংহার বা অতি-সরলীকরণের সমাধানের চেয়ে চর্চাটাকেই বেশি
মুল্য দিত। বড়জোর হয়ত
বলত
– “আমার মতে এটা এরকম,
কিন্তু ভিন্নমত থাকতেই পারে!”
এই
ব্যাপারটা একদিন থেকে দেখতে গেলে হয়ত ওনার মডেস্টি, কারণ বড়কাকার মত পড়াশোনা জানা লোক
তো খুব বেশি হয়না! কিন্তু আবার, অন্যভাবে
দেখতে গেলে এটা কিন্তু বিনয় ঠিক নয়, বরং বলা চলে একপ্রকারের স্বচ্ছতা। বেশিরভাগ যে
কোন বিষয়ের প্রতিই বড়কাকার দেখার দৃষ্টি বা চিন্তাভাবনার পারস্পক্টিভ ছিল ডীপলি অব্জেকটিভ,
নিউট্রাল, আনঅ্যাটাচড। যেটাকে আধ্যাত্মিক ভাষা ধার করে বলতে গেলে বলতে হয় এভিডেনশিয়াল
(দ্রষ্টাভাব) রাদার দ্যন এক্সপেরিয়েনশিয়াল (ভোক্তাভাব)। মানে সত্যি বলতে কি, একজন অ্যাকটিভিস্ট
আর একজন ফিলোজফারের যেটা প্রাথমিক তফাৎ - একজন প্রাণপণে বিশ্বাস করে, পক্ষ নেয়, প্রতিবাদ করে, প্রভাবিত করার চেষ্টা
করে; আর আরেকজন প্রশ্ন করে, অনুসন্ধান করে খোলা মনে, বিজ্ঞানমনস্কভাবে, নির্বিচারে!
বড়কাকা, অন্তত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি যা দেখেছি, ভীষণভাবে
এই দ্বিতীয়টা। আর - প্রথম গ্রুপের গুরুত্ব অস্বীকার না করেই বলছি - আমার মতে
বড়কাকার মতন করে এতটা বেশি করে মনেপ্রাণে এই দ্বিতীয়টা হওয়াটা কিন্তু কোন সহজ কথা একেবারেই নয়। এটা ইন
ফ্যাক্ট একটা উচ্চমানের স্পিরিচ্যুয়াল কোয়ালিটি বললেও একটুও বাড়িয়ে বলা হবেনা!
(১২)
বড়কাকাকে সবসময় বর্তমানকালে যখন যেমন দেখেছি, যা নিয়ে কথা বলেছি, তখনকার মতন
স্বাভাবিক নিয়মেই সেই মুহূর্তটার সাথে সামিল হয়ে গেছি। যখনই কোন কথা মাথায় এসেছে
যেটা বড়কাকার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হয়েছে, দু’পা বাড়িয়ে বা যান্ত্রিক মাধ্যমে দু’
মুহূর্তের মধ্যে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া গেছে।
আর এখন, এমন হঠাৎ করেই, কোন ওয়ার্নিং ছাড়া কোন প্রস্তুতি ছাড়া মনে হচ্ছে
যেন কেউ একটা এসে সাঁকোটা ভেঙ্গে দিয়ে গেল, অনেকটা দুরত্ম গড়ে দিলো বড়কাকার সাথে
আমাদের বাকিদের সবার। যে জিনিসটাকে জ্ঞান হওয়া থেকেই অধিকার বলে জেনেছি, সেই
জায়গাটা আজ হঠাৎ আর নেই!
আবার এই দুরত্মটাকে যখন মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছি, বুঝতে পারছি যে বড়কাকাকে
বর্তমানকাল দিয়ে আর কোনদিনই ধরা যাবেনা, তখন আবার অনেকদিন আগের থেকে এই–তো-সেদিনের
অবধি অজস্র কথা, অনেক ঘটনার স্মৃতি ভেসে উঠছে যেগুলোকে এর আগে কখন একত্র করে
মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়নি, সুযোগ হয়নি কখনো। এখন, যতই মিলিয়ে দেখার চেষ্টা
করছি ততই অবাক হচ্ছি, যেন নতুন করে চিনতে পারছি মানুষটাকে। স্মৃতির টুকরোগুলো জিগস্য
পাজেলের মত খোপে খোপে মিলিয়ে একটা আশ্চর্য অবয়ব তৈরি হচ্ছে এমন একজন মানুষের, যে
আর পাঁচটা দশটা মানুষের চেয়ে, আর শত সহস্র মানুষের চেয়ে বহুগুণে মনুষ্যত্তর,
অভিনব, লারজার দ্যন লাইফ। রবীন্দ্রনাথের ভাষা ধার করে বলতে গেলে বলতে হয় – “সৃষ্টিকর্তার অট্টহাসি!”
আবার, এই যে “সৃষ্টিকর্তা” বা “বিধাতা” বলে কেউ আছে কিনা, জন্মান্তর বলে কিছু
হয় কিনা, পাপ পুণ্যের কোন কম্পাইলেশন বা হিসেবনিকেশ আদৌ হয় কিনা, মৃত্যুর ওপারে ঠিক কি আছে বা থাকতে পারে – এই নিয়ে
বড়কাকার সাথে কত আড্ডা, বিতর্ক, নানারকমের অল্টারনেটিভ থিয়োরি বা ফিলোজফি নিয়ে
দিনের পর দিন কথা হয়েছে। তার থেকে আমার অন্তত ধারণা, বড়কাকা সবার নানারকম বিশ্বাসবোধকে
সম্মান করত ঠিকই, কিন্তু নিজে ব্যাক্তিগতভাবে
ঠিক অবিশ্বাসী বা ননকনফরমিস্ট না হলেও অন্তত অ্যাগনস্টিক তো বটেই। ধর্মবোধের একটা আধ্যাত্মিক
অনুসন্ধানবোধ থাকলেও রিচ্যুয়ালস বা ধর্মীয় আচারের প্রতি
বড়কাকার অন্ধবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠেনা, বা ছিল না কোন নিয়মভাঙ্গার
ধর্মভয়! আর নিজে সরাসরি কোনভাবে ব্রহ্মবাদী না হলেও ব্রাহ্মধর্মের ব্যাপারে বা নিরাকারবাদ
নিয়েও বড়কাকার বেশ পড়াশোনা, আর অনেকটা শ্রদ্ধাও ছিল। আমি বড়কাকাকে যেমন দেখেছি, হি
ওয়াজ ডীপলি ইন্সপায়ারড অ্যান্ড ইনফ্লুএন্সড বাই টেগোর।
কিন্তু আবার এই
মানুষটাই কিন্তু কালীপূজোয় প্রতিবছর রাতভোর উপোষ করত, দিদার কাজ করার সময় সত্যিই,
মানে আজকালকার দিনেও, মালসায় চাল ফুটিয়ে ভাত রান্না করে খেয়েছিল। কনফিউজিং? বোধ হয়
না! আসলে, বড়কাকার কাছে রিচ্যুয়াল জিনিসটাও একরকমের এক্সপেরিমেন্টের বস্তু, সেটার
প্রতিও বড়কাকার যেন একটা অ্যাকাডেমিক কিউরিওসিটি। আর তার সাথে কাউকে আঘাত না দেওয়ার চেষ্টা, কারণ – “কে বলল আমি তাঁর থেকে বেশি জানি?” বড়কাকার যেন পুরো
জীবনটা ধরেই, চলার পথে যেখানেই যখন চোখ আটকাবে, যতটুকু অবকাশ পাওয়া যাবে, সেখানেই
দাঁড়িয়ে পড়ে সেই আগ্রহের বিষয়টাকে ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস দিয়ে কাছ থেকে দেখা। অত্যন্ত
ডাইভারস আর অদ্ভুত সব বিষয়ের প্রতি একটা অসম্ভবরকমের হাইপারঅ্যাক্টিভ, এক্সপেরিমেন্টাল,
রেস্টলেস মাইন্ড। নিরাসক্ত, নিরুদ্বিগ্ন কিন্তু অত্যুৎসাহী, কৌতূহলী মন থেকে এক
বার নেড়েচেড়ে দেখা, হাতে কলমে চেষ্টা করে দেখা। “করেই দেখা যাক না!” – গোছের একটা
ব্যাপার, নিরন্তর!
এই “করেই দেখা যাক না!” –টা যে ঠিক কতদূর গড়াতে পারে, সেটা
যারা বড়কাকাকে কাছ থেকে দেখেছে তারাই একমাত্র বুঝবে। যে কোন বিষয়ই শুরু হত একটা অতি
সামান্য, চোখ এড়ানো গোছের অবজারভেশন থেকে। যেমন ধরা যাক – বাড়ির বাতাবী লেবুর গাছটায়
মৌমাছি বাসা বেঁধেছে,
তাই
মুখে গামছা বেঁধে মশাল হাতে করে মৌচাক ভাঙতে গাছে ওঠা একদিন অন্ধকার সন্ধ্যেবেলায়।
এবারের সেই ঘটনা থেকেই আস্তে আস্তে প্রথমে একটা আইডিয়ার জন্ম, তারপর ধীরে ধীরে একটা ইন্টারেস্ট গ্রো করা, এবং তারপর অনতিকালে সেটাই একটা প্যাশনে
পৌঁছে যাওয়া।
আর তার সাথে অবশ্যই একটা ল্যাব-সাইন্টিস্ট ভিউপয়েন্ট – আচ্ছা, মৌমাছির চাষ করে দেখলে কেমন হয়? ব্যস!
এসে গেলো বিশেষভাবে অর্ডার করা কাঠের খোপ খোপ করা চৌকো বাক্স, রানী মৌমাছি, ইত্যাদি।
সেটার অবশ্য মাত্র কয়েকবছরের মধ্যেই পঞ্চত্বপ্রাপ্তি হয়, কারণ ক্ষুদ্রমনের
মানুষজন যেমন হয় আর কি, আশপাশের
প্রতিবেশিরা তো বটেই এবং তারপর নিজেদের বাড়ির লোকেরাও একটা পয়েন্টের পর মৌমাছির
হূল ফোটানোর ব্যাপারটাকে আর ঠিক স্নেহের চোখে দেখে উঠতে পারল না।
মৌমাছির চাষও উঠে
গেলো, আর তাঁর সাথে বড়কাকার এক্সপেরিমেন্ট গুলোও কিরকম আস্তে আস্তে গৃহমুখী হয়ে উঠতে শুরু করল – যেমন, কোল্ডড্রিঙ্ক
দিয়ে ভাত রান্না করা, রিয়ার-ভিউ মিরর লাগানো পড়ার ঘরে,
ইত্যাদি। এই সমস্ত কাজ কিন্তু আপাতঃ দৃষ্টিতে ভীষণ রকমের
ভিন্নধর্মী হলেও আসলে কোথাও একটা এসে মিলে মিশে যায়। মানুষটাকে একটু ভাল করে জেনে গেলেই
বোঝা যায়, যে মোটামুটি চারপাশের পৃথিবীটাকে উনি নিজের ল্যাবরেটরি ঠাউরে নিয়েছেন, আর
এই সবকিছুই জাস্ট তাঁর নানারকমের কিউরিয়াস এক্সপেরিমেন্ট। কোনরকম জাজমেন্ট না করে,
কোনরকম তত্ত্বকথায় বা অকারণ, অপ্রয়োজনীয় ভাল-মন্দ বিচারে সময় নষ্ট না করে সব কিছুকেই
একটা চান্স দেওয়া, আর তাঁর সাথে নিজেকেও… একটা চান্স দেওয়া! বেঁচে থাকা, সজীবভাবে;
বেঁচে নেওয়া!
(১৩)
বড়কাকার মানসিকতায় জাজমেন্ট ব্যাপারটা যে কিরকম একেবারেই ছিলনা, সেটা ভাবি এখন। যেমন, অতুলপ্রসাদ থেকে অনুপম, শ্যামাসংগীত থেক সুমন, সব গানই কিন্তু বড়কাকা ঠিক একই রকমের উৎসাহ নিয়ে সংগ্রহ করত, মন দিয়ে শুনত, আর বলা যায় সেলিব্রেটও করত। আমাদের জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে আসছি, জন্মাষ্টমীর দিন ভোর ছ’টা থেকে রেকর্ড বাজতে শুরু করত – "হরে কৃষ্ণ নাম দিল প্রিয় বলরাম, রাখালরাজা নাম রাখে ভক্ত শ্রীরাম।" পঁচিশে বৈশাখ তো বেশ সমারোহ করে উদযাপন করত বড়কাকা। ইন ফ্যাক্ট কাকিম্বাবার কাছে শুনলাম এবছরও, অর্থাৎ এই ২০১৬র মে মাসেই মানে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার জাস্ট দু-তিনদিন আগেই, বড়কাকা নাকি ভোরবেলা বাজার থেকে ফুলের মালা ইত্যাদি কিনে এনেছে রবীন্দ্রনাথের ফটো সাজানোর জন্য, প্রতি বছরের মত। বড়কাকার সাথে “মহানগর” বা “অযান্ত্রিক” নিয়ে যেমন আড্ডা হয়েছে, আবার এও দেখেছি যে বড়কাকার ল্যাপটপে ঠাসা, হার্ড ড্রাইভ বোঝাই করা জিৎ-কোয়েল বা দেব-শুভশ্রির রিসেন্ট রিলিজ! নাহ, ওগুলো নিয়ে আমার সাথে বড়কাকার কোনদিন আড্ডা হয়নি, সত্যিই বলছি। বরং, হেসে মরতাম বড়কাকার কালেকশন দেখে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আসলে বড়কাকা কখনই – অল্মোস্ট অ্যাজ আ ম্যাটার অফ প্রিন্সিপ্যাল - কাউকেই, কোন কিছুকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত না।
আরেকটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, এটা বলতে গিয়ে। এই লাস্ট ডিসেম্বরে কলকাতায় গিয়ে অপর্ণা সেনের “আরশিনগর” দেখতে গেলাম। যারা দেখেছেন তারা আশা করি আমার সাথে একমত হবেন, যে সিনেমাটি অত্যন্ত হাস্যকর রকমের খারাপ হয়েছে। তা, আমি দেখে এসে হিউমারাস টোনে খুব কড়া সমালোচনা করে একটা রিভিউ লিখে আমার ব্লগে পোস্ট করলাম। বন্ধুরা পড়ে অনেকেই বাহবা দিল, হিউমারের প্রশংসাও করল কেউ কেউ, আর অনেকেই নিজের ওয়ালে শেয়ার করল সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরেরদিন সকালে যখন বড়কাকার সাথে দেখা করতে গেলাম, বড়কাকা কিন্তু বেশ একটু বকেই দিলো আমায়; সাথে, কাকিম্বাবাও। বলল, “হতে পারে উনি কিছু একটা অন্যরকমের কাজ করতে চেষ্টা করেছিলেন আর সেটা জমেনি, উৎরিয়ে যায়নি যেমনটা ভেবেছিলেন, এক্সপেরিমেন্ট সাক্সেস্ফুল হয়নি। হতেই পারে! কিন্তু আরশিনগর যেমনি হোক, উনি তো অপর্ণা সেন! কতবড় পন্ডিত ব্যাক্তি, ভাবা যায়? ওনার সিনেমার রিভিউতে তুই অডিয়েন্স হিসেবে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারিস, কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজমও নিশ্চয়ই করতে পারিস, কিন্তু সেটার ভঙ্গিটা অবশ্যই হতে হবে নম্র, বিনয়ী, শ্রদ্ধাপূর্ণ।“ আমার বই বা সিনেমার রিভিউ লেখার ধরণ – বা, ধরণ না বলে হয়ত ভয়েস বা টোন বলাটাই বেশি সমীচীন, এই ঘটনার পর থেকে কিন্তু সচেতন ভাবেই বদলে গেছে।
ও, আর সিনেমার কথা যখন উঠলই তখন এই প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়!
“বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না” সিনেমাটা তখন সবে
মাত্র রিলিজ করেছে। আমি তখন বেশ ছোটই, বড়কাকা আর কাকিম্বাবার সাথে দেখতে গেছি সিনেমাটা শ্রীকৃষ্ণ হলে, মানে বাদু রোডে। উপচে পড়ছে ভিড়,
ব্ল্যাকে টিকিট কেটে বড়কাকা আমাদের নিয়ে ঢুকল। ঢুকে দেখা গেলো সীট সব ভর্তি,
উদ্যোক্তারা অর্থাৎ ব্ল্যাকাররা তাই ফ্রন্ট রোয়ের সামনে চটের বস্তা বিছিয়ে রেখেছে
আমাদের মতন নাছোড়বান্দা দর্শকদের জন্য। হ্যাঁ! বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না সিনেমাটা –
আমি গর্ব করেই বলছি – আমার দেখা হয়েছিল ওই শ্রীকৃষ্ণ হলে স্ক্রীনের থেকে দু’ফুট
দুরত্বে মাটিতে চটের ওপরে বসে।
(১৪)
এবারে যখন গেলাম
কলকাতা, বড়কাকার সাথে দেখা হল – ওদের বাড়িতে না, হসপিটালে। আমাকে দেখেই প্রথম কথা –
“টুয়া, বড় বিপাকে পড়ে গেছি রে!” আর তারপরেই কথা ঘুরিয়ে –“ইওরোপের কোথায় কোথায় গেলি,
কি কি দেখলি? পিসার টাওয়ার দেখলি? ওটা কত ডিগ্রী এঙ্গেলে হেলে থাকে?” আমি বললাম – “পিসায় স্ট্রাইক চলছিল, তাই টিকিট কাটা
ছিল তাও যেতে পারিনি, ফ্লোরেন্স থেকে প্ল্যান চেঞ্জ করে ভেনিস চলে গেছি। তবে,
আইফেল টাওয়ার দেখেছি, ওপরে চড়েছি। ভ্যাটিকান
চার্চ গেছি, ডিজনিল্যান্ড, কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমাদের সিনেমা দেখানো হয়েছে, রেড কার্পেটে হেঁটেছি... তুমি
শিগগির বাড়ি ফেরো! অনেক গল্প জমানো আছে তোমাকে বলার জন্য!”
আর বলা হয়নি
গল্পগুলো, আর সুযোগ পাওয়া যায়নি। নেক্সট যেদিন দেখা হল, সেদিন কথা বন্ধ হয়ে গেছে,
শুধু চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করল কবে ফিরে যাব। আমি বললাম – “আমি এখন আছি, তুমি আগে ঠিক হয়ে নাও।“ ৬ তারিখ আমার ফেরার টিকিট ছিল; সেদিন সকালবেলা যখন বড়কাকা চলে গেলো, কাকিম্বাবা
বলল – “তোকে এত ভালবাসে তো, তুই যাতে দেখে যেতে পারিস তাই সময় বুঝে চলে গেল।“ আর,
যে মুহূর্তে ফাইনালি ঘটল ব্যাপারটা, আমার নিজের একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল।
সারাক্ষণই ছিলাম ওখানে, মানে বিছানার পাশে, বোধ হয় মিনিট পনের আগেই একবার বাড়িতে
গেছি ফ্রেশ হতে। মা এবাড়ির সবার জন্য যা হোক একটা ডাল ভাত চাপাচ্ছে, আর আমি টেবিলে
দাঁড়িয়ে ছুরি দিয়ে আলু কাটছি। হঠাৎ কি মনে হল, খুব আর্জেন্ট টাইপের একটা ফিলিং... একটা
আলু অর্ধেক কাটা হয়েছে; ছুড়িটা যেমন ছিল তেমন রেখেই চটিটা পায়ে গলিয়ে হাঁটা
লাগালাম ওদের বাড়ির দিকে। মা পিছন থেকে ডাকল, “মেয়েটাকে একটু ফ্রেস করে দে, আমি
ব্যস্ত, আর কিছু হলে ওরা তো তোকে ডাকবে!” আমি না দাঁড়িয়ে “এক্ষুনি আসছি” বলে দৌড়
লাগালাম, কেন জানিনা। পৌঁছে দেখি, ঠিক তখনি, বোধ হয় এক মিনিটও হয়নি - নিশ্বাস বন্ধ
হয়ে গেছে, চলে গেছে তক্ষুনিই...
বড়কাকাকে টাটা
মেডিকাল সেন্টারে থাকার সময় দেখতে গিয়ে আমি কত বড়মুখ করে বলেছিলাম – “বড়কাকা, এই
কেমোর ফেজ-টা সবার কাছেই শুনেছি খুব কষ্ট হয়। একটু সহ্য করে নাও? এই ফেজ-টা ওভার
হয়ে গেলেই দেখবে পুরো ঠিক হয়ে যাবে, আবার আগের মতন।“ বড়কাকা বিশ্বাস করেছিল কিনা
জানিনা, বলেছিল – “সেটা হয়ত ঠিক, কিন্তু এই ফেজ-টার ডিউরেশন কতটা সেটাই তো বুঝতে
পারছিনা!”
কি ভীষণ মিথ্যেবাদী
লাগছিল নিজেকে, সেই মুহূর্তটায়!
(১৫)
আস্তে আস্তে সবারই বয়স হচ্ছে, শরীর ভেঙ্গে যাচ্ছে – সবই জানি, তবু কেন জানিনা বড়কাকা যে একদিন এভাবে চলে যাবে, এটা একেবারেই কোনরকম হিসেবের মধ্যেই ধরা ছিল না। বড়কাকার সাথে আর কোন উদ্ভট এক্সপেরিমেন্ট করা হবেনা, নানান নামগোত্রহীন খাপছাড়া বিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারা যাবেনা আর কোনদিন – এই অভাববোধটা যে কতোটা গভীর আর কতটা অপূরণীয়... তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার ক্ষমতার বাইরে। আবার, যে মানুষটাকে আমাদের নিজেদের আজন্ম অধিকার বলে জেনে এসেছি, তাকেই এখন এই এপার–ওপারের দুরত্ম থেকে দেখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, আমাদের, আমাদের প্রত্যেকের কি ভীষণ ভাগ্য যে আমরা বড়কাকাকে পেয়েছি; এত ভাল করে, এত কাছ থেকে, এত বেশি করে পেয়েছি। বড়কাকার চলে যাওয়ার যে শোক, সেটাকে পেরিয়ে এই আশ্চর্য পাওয়াটার কথা যখন ভাবছি, ডেবিট ক্রেডিটের হিসেবের খাতায় আফসোসের চেয়ে মন খারাপের চেয়ে সেই কৃতজ্ঞতার ওজন অনেক গুনে ভারী! মনে হচ্ছে আমরা কি লাকি, কি ভীষণ লাকি, যে আমাদের বড়কাকা ছিল! আর তো কারোর নেই, কারোরই থাকেনা!
জায়গাটা কেমন, বড়কাকা এখন কি করছে – কে জানে! বড়কাকার এখনকার অস্তিত্বে কি কোন
স্মৃতি আছে, আমরা কি আছি সেখানে? আমাদের মন খারাপ করাটা কি পৌঁছচ্ছে, বড়কাকার
কাছে? নাকি, বড়কাকার নতুন কোন আইডিয়া মাথায় এলো? ফাইনালি, যখন কোন একদিন সময়
হবে... তখন আবার কি দেখা হবে, সবার? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না জানলেও একটা কথা
নিশ্চয়ই জানি যে বড়কাকা যেখানেই থাক, ডেফিনিটলি ভাল আছে। আসলে, যে পরিস্থিতিতেই বা
যে অবস্থাতেই থাক, বড়কাকাকে কোনদিন খারাপ থাকতে দেখিনি আমরা কেউ। বড়কাকা কোনদিন
খারাপ থাকতে জানতই না, খারাপ থাকবে কি করে?
আর কে জানে, বড়কাকার এই হঠাৎ চলে যাওয়াটাও হয়ত সেই নিরাসক্ত, অনুসন্ধানী মনের
আরো একটা কৌতূহলী এক্সপেরিমেন্ট মাত্র!
(১৬)
এখন মনে পড়ছে, অনেকবারই
আর সেই অকস্মাৎ তিরিশে মে-র পর থেকে আরোই বেশি করে - ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে বড়কাকার
সাথে আমার মাঝেমাঝেই আলোচনা হত। উনি
যেভাবে চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করতেন, বিশেষ করে মৃত্যুর দৃশ্যে ওনার
রবীন্দ্রসংগীত নির্বাচন... সেটা বোধ হয় একটা পিএইচডি থিসিসের বিষয় হতে পারে! আমরা যারা
সাধারণ বাঙালি পরিবেশে বড় হয়েছি, তারা ছোট থেকেই জেনে এসেছি যে মৃত্যু মানেই
রজনীগন্ধার স্টিক, ধূপকাঠি, আর হয় “আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু” অথবা বড়জোর “যখন
পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে।“ ঋতুপর্ণ ঘোষ কিন্তু আমাকে এই বিষয়টায় ভাবিয়ে
মেরেছে! “সব চরিত্র কাল্পনিক”-এ সেই সুসজ্জিত ফাঁকা ঘর জুড়ে অভিমানে ঠাসা একটা
নৈঃশব্দ্য, আর ক্যামেরা প্যান করে যাচ্ছে এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়াল। আর তারপরেই
নেপথ্যে শুরু হয় – “এ পরবাসে রবে কে!” শুভ মহরতে বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে আসে
একটা অমোঘ লাইন – “জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে...” “গানের
ওপারে” তে একটা এপিসোড মনে পড়ে। বড়মেয়ে চলে যাচ্ছে, বৃদ্ধ বাবা তার মৃত্যুশয্যায়
পাশে বসে উদাত্ত গলায় গান ধরল – “আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা। নীল
আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা?”
এখন মনে পড়ছে সেইসব
আড্ডার কথা। আর ভাবছি, বড়কাকার জন্য কোন রবীন্দ্রসংগীতটা অ্যাপ্রপ্রিয়েট হত, কে
জানে? অনেক ভেবেও ঠিক করে উঠতে পারছিনা কিছুতেই। তাই, বড়কাকার জন্য “মৃত্যুঞ্জয়”
কবিতাটাই থাক, বরং –
বড়কাকা, তুমি
“মৃত্যুর চেয়ে বড়!”
No comments:
Post a Comment
Did you like it? Did you not? Please leave a comment...