অভিজিত রায়, একজন মার্কিন নিবাসী বাঙালী লেখক, এক “মুক্ত-মনা” চিন্তাধারার লেখক এবং প্রতিষ্ঠাতা, গত ২৬-শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যেবেলা, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক তিনদিন আগে, বাংলাদেশের একুশে বইমেলা থেকে পায়ে হেঁটে নিজের বাড়ি ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এবং নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনের থেকে ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে, জনসমক্ষে চপার দিয়ে কুপিয়ে খুন হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা , যিনি যেটুকু পরিচয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে সার্থকঅর্থেই অভিজিৎ বাবুর সহধর্মিণী, তিনি প্রাণে বেঁচে গেছেন কিন্তু গুরুতর আহত।
ওনাদের অপরাধ – ওনারা মুক্ত-মনে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের কথা লিখতেন এবং লেখার মাধ্যমে প্রচার করতেন।
হ্যাঁ, জাস্ট এইটুকুই।
লিখতেন, জাস্ট এইটুকুই তাঁদের অপরাধ!
লিখতেন, জাস্ট এইটুকুই তাঁদের অপরাধ!
---------------------------
আর খবর বলতেও, এইটুকুই!
বাকিটা, স্রেফ একটা অজানা ধরণের দম বন্ধ হয়ে আসা, গলার কাছে ডেলা পাকানো নিঃশব্দ একটা ভয়, দু’হাতের মুঠো পাকিয়ে আসা নিষ্ফল, অব্যক্ত একটা রাগ। আর এইসবের ঊর্ধ্বে, এইসবকিছুর ঊর্ধ্বে, একটা ভীষণ, ভীষণ অবাক হওয়া। মানে, সত্যি? সত্যি এরকম হতে পারে? আজকে, এই ২০১৫তে?
গত দু-তিনদিন ধরে অভিজিৎ রায়কে ঘিরে নানান কথাবার্তা, আলোচনা, দুপক্ষের – হ্যাঁ, দুপক্ষেরই – উল্লাসের উত্তরে ঘৃণা, সেই ঘৃণার প্রত্যুত্তরে আরও চার ডিগ্রী অধিক ঘৃণা, কাদা, গালাগালি, আক্রমণ, এইসব দেখছি। আবার পাশাপাশি এও দেখছি – ছেলেটার আর মেয়েটার কি সুন্দর সতেজ, পবিত্র, আনন্দময়, উজ্জ্বল হাসিমুখ। পাঠকদের অটোগ্রাফ দিচ্ছে, চায়ের ভাঁড় হাতে খোশগল্প করছে, দুজন ঠিক আমাদের মতনই প্রবাসী, সম্ভবত হোমসিক, দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর বাড়ি-ফেরা দুজন যুবক – যুবতীর কিছু আন্তরিক বন্ধু-মুহূর্ত। মৃত্যুর জাস্ট ঘণ্টা-খানেক আগেরই ছবি। একুশের বইমেলায়, যেখানে অভিজিতের নতুন বই ছেপে বেরিয়েছে।
আবার দেখছি, “মুক্তমনা” ওয়েবসাইট, যা কোন অজ্ঞাত কারণে ব্লক হয়ে আছে সেই অভিশপ্ত খবরটি প্রকাশ মুহূর্ত থেকেই, কিন্তু তারই মধ্যে কিছু পুরনো, আর্কাইভ করা লেখা, বা অভিজিতের ফেসবুক ওয়ালের কিছু পোস্ট আর আলোচনা। সেগুলো প্রত্যেকটা পড়ে অবধারিত ভাবে একটা কথাই সমানে, বারে বারে মনে হচ্ছে - আরে! এরা তো একদম আমার মতো, আমাদের মতো করেই ভাবে!
সরি, গ্রামাটিকাল মিস্টেক হয়ে গেলো! “ভাবতো”।
---------------------------
---------------------------
অভিজিতের এই খুনের ঘটনাটা নিয়ে গত তিনদিন ধরে বেশ কয়েকবার লিখতে বসে তারপর রণে ভঙ্গ দিয়েছি। ঘেঁটে গেছি। এই লেখাটাও যারপরনাই অগোছালো হচ্ছে, রাস্তা হারাচ্ছে। সত্যি বলতে কি, আমি না ঠিক জানিনা কি লিখবো, বা আদতে আমি অনুভবটাই বা ঠিক কি করছি!
সহমর্মিতা?
হয়ত! নিজের থেকে বয়েসে সামান্য বড়, চিন্তাধারার সঙ্গে ভীষণভাবে রিলেট করা যায় এমন একজন মানসিকতার মানুষের এই নির্মম অকালপ্রয়াণ যে স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরকে বেদনা দিচ্ছে, সে তো বলাই বাহুল্য!
হয়ত! নিজের থেকে বয়েসে সামান্য বড়, চিন্তাধারার সঙ্গে ভীষণভাবে রিলেট করা যায় এমন একজন মানসিকতার মানুষের এই নির্মম অকালপ্রয়াণ যে স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরকে বেদনা দিচ্ছে, সে তো বলাই বাহুল্য!
ভয়?
হ্যাঁ, তাও। স্রেফ নিজের বিশ্বাসের কথা সাহস করে বলার জন্য, লেখার জন্য এইরকম ভয়াবহ পরিণতি? আর, রাস্তায় লোকজন সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখল, একে অপরের ঘাড়ে মাথা ভর করে দেখল, আর কেউ এক পা এগিয়েও এল না পর্যন্তও? আমরা, আমাদের প্রাণ, আমাদের এই জীবন, এই বেঁচে থাকা, এই সবকিছু – এতটাই সস্তা? এতটাই ঠুনকো, ক্ষণস্থায়ী? আর, মনের কথা বলাটা, সেই সৎসাহসটা - এতটাই বিপজ্জনক, এতটাই ভয়ানক?
হ্যাঁ, তাও। স্রেফ নিজের বিশ্বাসের কথা সাহস করে বলার জন্য, লেখার জন্য এইরকম ভয়াবহ পরিণতি? আর, রাস্তায় লোকজন সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে দেখল, একে অপরের ঘাড়ে মাথা ভর করে দেখল, আর কেউ এক পা এগিয়েও এল না পর্যন্তও? আমরা, আমাদের প্রাণ, আমাদের এই জীবন, এই বেঁচে থাকা, এই সবকিছু – এতটাই সস্তা? এতটাই ঠুনকো, ক্ষণস্থায়ী? আর, মনের কথা বলাটা, সেই সৎসাহসটা - এতটাই বিপজ্জনক, এতটাই ভয়ানক?
আর রাগ?
জানিনা। সত্যিই জানিনা।
রাগ করার জায়গা কি আর আছে? বা, বুকের পাটা? নাকি, কখন অন্ধকার একটা কোনা দেখে চট করে লুকিয়ে পড়ব, নিজের পিঠ বাঁচাবো, শুধু সেই সুযোগটুকুরই অপেক্ষা?
---------------------------
জানিনা। সত্যিই জানিনা।
রাগ করার জায়গা কি আর আছে? বা, বুকের পাটা? নাকি, কখন অন্ধকার একটা কোনা দেখে চট করে লুকিয়ে পড়ব, নিজের পিঠ বাঁচাবো, শুধু সেই সুযোগটুকুরই অপেক্ষা?
---------------------------
আমি নিজে চিরকাল লজিকাল আরগিউমেন্টাটিভ নাস্তিক হিসেবে নিজেকে ভাবতে ভালবেসেছি। আমাদের নাস্তিকদের অনেক আলোচনাতেই প্রধানত যেটা শুনতে হয়, বা নানান ক্ষেত্রে নিজেদের বক্তব্যকে নিজেরাই যে ডিস্ক্লেমারের মোড়কে মুড়ে পেশ করতে হয়, তা হল – আমাদের বিশ্বাস (অর্থাৎ কিনা, অবিশ্বাস - যদিও আমি ব্যক্তিগত ভাবে নাস্তিকতাকে ধর্ম বলে মানি।) এবং বক্তব্য, যেটা আমরা উপস্থাপন করছি, তা আমরা যেন অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি যথেষ্ট সহিষ্ণুতা এবং সম্মান রেখে তবেই বলি। (যে ধর্মবিশ্বাস কিনা এই ২০১৫তে দাঁড়িয়েও সচরাচর গৃহস্থবাড়িতে হপ্তায় দুই থেকে তিনদিন উপোষ থাকা বা নিরামিষ খাওয়া, বা মুসুরির-ডালের ডেকচিটা শুক্তোর কড়াইয়ে অসাবধানতাবশত ঠেকে যাওয়ার মতো সূক্ষ্ম সুতোর বিচারব্যবস্থার ওপর প্রায়শই নির্ভর করে থাকে।)
বারবার যখন আমাদের উদ্দেশ্যে, ইঙ্গিতে বা প্রকাশ্যে, এটা বলা হয় যে আমাদের নাস্তিকতা যেন ননজাজমেন্টাল হয়, যাতে কোন প্রকারের বিশ্বাসকেই সে ক্লাসিফাই করার স্পর্ধা না ধরে, র্যাঙ্ক না করে, আমার সত্যি বলতে তখন একটু খটকাই লাগে! আবার অপরদিকে আস্তিকদের মধ্যে এই সহিষ্ণুতার সতর্কীকরণবার্তা প্রচারের চল কিন্তু অতটা নেই। তাঁরা ভগবান নামক বস্তু(?)-টির কাছাকাছি তো, হয়ত তাই! কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই অসহিষ্ণুতা কিন্তু রক্ত ঝরানোর ক্ষমতা রাখে। এই অসহিষ্ণুতা অভিজিতের, বন্যার রক্ত খায়!
এইজাতীয় তর্কের মুহূর্তে অনেকবারই আমি বোকার মত, ঠ্যাঁটার মত, গাধার মত, একা বা বন্ধুরা দল বেঁধে তর্ক করেছি কিছুদূর পর্যন্ত। বলেছি – ব্যক্তি আক্রমণ না করেই বলেছি – কোথাও যদি একটা জাজমেন্ট না থাকে, তাহলে তো এগিয়ে যাওয়া আর পিছিয়ে পড়ার মধ্যে তফাৎটুকুও করতে পারবনা আমরা; বিদ্যাসাগর আর আসারাম-বাপুর মধ্যেও কি তাহলে কোন র্যাঙ্কিং
হবে না?
এঁড়ে তর্ক হয়ত! হয়ত ক্ষমা-ঘেন্না করে পাশ কাটিয়ে গেছে অপর-পক্ষ।
কিন্তু কি ভাগ্য আমার - আজ মনে হচ্ছে! কি ভাগ্য আমার, যে অভিজিতের মতো এতো সাহস, এতো মনের জোর কোনদিন হয়নি, যে এটা নিয়ে “কাজ” করব। লিখবো, প্রচার করব, মানুষকে ভাবাবো! সেই ক্ষমতা, ব্যাপ্তি, সেই পড়াশোনা, সেই প্রস্তুতি, ভাগ্যিস নেই আমার। সবচেয়ে বড় যেটা, দম-ই নেই!
আর স্রেফ সেই জন্যেই, হয়ত জাস্ট সেই জন্যেই, আজকে, এই মুহূর্তে, এই মুহূর্তে বেঁচে আছি আমি। অভিজিৎ, আর নেই!
---------------------------
---------------------------
কিন্তু আবার, যদি এইভাবে ভাবো, আমরা বেঁচে আছি কিন্তু। এখনো বেঁচে আছি! তুমি, আমি, আমরা কয়জন, এখনো বেঁচে আছি! বেঁচে আছি কিন্তু, ভেবে দেখো!
হয়ত আমাদের কারোরই একার সেই ক্ষমতা নেই। সাহস নেই, প্রস্তুতি নেই, দম নেই। কিন্তু, সবাই মিলে যদি একটা চেষ্টা করা যায়?
ভয় করছে, হতাশ লাগছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এখনো।
তবু, বিশ্বাস রাখছি। বিশ্বাসটা অন্তত থাক!
আজকের খবরে অভিজিৎ স্রেফ মৃত। কালকের খবরে অভিজিৎ মৃত্যুঞ্জয় হয়ে উঠুক!
No comments:
Post a Comment
Did you like it? Did you not? Please leave a comment...