ধপাস দেখতে দেখতে কিরকম তরতরিয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে...
যুক্তি সাজিয়ে নিজের ভিউ-পয়েন্ট খাড়া করে – না ঝগড়া না, রীতিমতন বাক্যবাগিশ তর্কালঙ্কারের
মতন করে নেগোশিয়েট করে দাপটের সাথে। আমাকে কম্পিউটারে বসতে দেখলেই সরিয়ে দিয়ে নিজে নিজেই ইউটিউব
খোলে, তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা প্যাপা-পিগ, মিস্টার-মেকার আর প্লে-ডো ভিডিও... জামাকাপড়
থেকে টিফিনের মেনু, ম্যাচিং জুতো থেকে বেড়াতে যাওয়ার গন্তব্য, এমনকি সিনেমা দেখতে গিয়ে
ইন্টারভেলের পপকর্ণের ফ্লেভার পর্যন্ত ওর ডিসিশনে চলছে আজকাল। এইতো সেদিন, দোকানে গিয়ে কি একটা পছন্দ
করেছে, বারণ করায় বলে – “আমি তোমাদের এতো কিছু কিনে দি, তোমরা আমাকে এইটুকু একটা জিনিস
কিনে দিতে চাইছনা?” স্কুল থেকে ফিরে চোখ বড় বড় করে গল্প বলে – “আজ যা একটা ঘটনা ঘটেছে
না, তুমি তো কল্পনাই করতে পারবেনা!!” অনির্বাণের কোন পাগলামি দেখলে মাথা চাপড়ে বলে
– “বাবার মাথাটা পুরো গেছে, আমি আর কিছু করতে পারব না!” আর পান থেকে চুন খসলেই আমার
ফোনটা নিয়ে নিজে নিজেই নম্বর ডায়াল করে আমার মা-বাবাকে ফোন করে আমার নামে নালিশ করা,
সেসব তো আছেই...
আমি যখনই কোন প্রসঙ্গে বলি – “আমি যখন ছোট ছিলাম...” অবধারিতভাবে পরের টার্নে ওর
নিজের গল্পটা শুরু হয় এভাবে – “ওয়ান্স আপন আ টাইম, আমি যখন বড় ছিলাম, তখন...”
ওর এতো তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাওয়া দেখে আমার মাঝেমাঝে খুব অবাক লাগে। মনে হয় – এই তো সেদিন হলো! এইতো সেদিন
- টেস্ট করে দেখলাম পজিটিভ, এই সেদিন একটু একটু করে বোঝা যেতে লাগলো, এইতো সেদিন হঠাৎ
ব্লিডিং, কতরকম দুশ্চিন্তা... তারপর, দিবারাত্রি
ইন্টারনেট থেকে আরোহণ করা প্রেগনেন্সি সংক্রান্ত জ্ঞান-সমুদ্র মন্থন, ডেলিভারি ভিডিও
ফিরে ফিরে দেখা আর শিউরে ওঠা, কথায় কথায় হপ্তায় হপ্তায় ব্লাড-টেস্ট আর আল্ট্রাসাউন্ড,
আর দিন-দুপুর রাত-বিরেত নির্বিশেষে শরীরের ভিতর থেকে ধাক্কাধাকি করে একটা অজানা, অদেখা
প্রাণী আমার যাবতীয় জেগে থাকা আর ঘুমের বারোটা বাজিয়ে চলেছে সর্বক্ষণ... আর এদিকে ওজন
বেড়ে চলেছে আমার, কোন জামাকাপড়ই আর ফিট হচ্ছেনা, কোমরে ব্যথা, পা ফুলে ঢোল... আর তারপর আর পারিনা, আর পারিনা করতে করতে হঠাৎ একদিন
ফাইনালি যখন দিনটা দুম করে এসে পড়ল, আর তারপর এইটুকু এইটুকু হাত-পা-ওয়ালা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র
একটা আস্ত মানুষ আমার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে, তখন
সেই আমারই আবার উল্টে মনে হওয়া – “ইহাও কি সম্ভব!!”
এইতো, কদিন আগেই – গলা-গলা সুজি বা সেরিল্যাক যাহোক কিছু একটা ঘন্ট পাকিয়ে ঠুসে
ঠুসে খাইয়ে দিতাম... আর সে কিনা এখন টিভিতে রান্না দেখে ফোন করে লোকজনকে রেসিপি শেখায়!
টিফিন যেমন কে তেমন ফেরত নিয়ে আসে, বলে স্যান্ডউইচে নাকি চীজ কম দেওয়া হয়েছে, তাই তিনি
খাননি! খাওয়ার সময় তো প্রতিদিনই তুলকালাম বাঁধে... তারপরে নেহাত কিনা গব্লিন-রা কোনদিন পায়রা কোনদিন মাছি আর কোনদিন বা শুকোতে দেওয়া
জামাকাপড় সেজে চলে আসে, তাই শেষরক্ষা হয়!
আগে যেমন খুশি যা হোক কিছু জামা-কাপড় জুতো পরিয়ে দিতাম, আর এখন তিনি হেয়ার-ব্যান্ড/
ক্লিপ মায়ে পায়ের মোজা পর্যন্ত ম্যাচিং ছাড়া পরেননা। অনুষ্ঠান বাড়িতে দিব্যি শাড়ি-টাড়ি পরে
যায়, সামলায়ও। শুধু তাইই না, কোথাও যাওয়ার সময়
পুরো পরিবারসুদ্ধ শবাইকে কালার কোঅরডিনেটেড জামাকাপড় পরিয়ে তবে ছাড়ে!
সবচেয়ে বড় কথা হলো, জীবনের প্রতিটা ব্যাপারে তাঁর প্রচুর, প্র–চু-র, “বক্তব্য”!
ভেবেচিন্তে, হাত নেড়ে নেড়ে, এমন করে নিজের অকাট্য যুক্তি প্লেস করে যে... যাকগে সে
কথা!
“না খেলে বড় হবি কি করে?” –র উত্তরে “তোমরা বড় হয়ে গেছো তো, এখনো খাও কেন?” শুনে
বাড়িতে সব মহারথীরাই একে একে রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছে। আমার মা তো খাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলতে
গেলেই – “থাক দিন, আমি তোমার মতো মোটা হতে চাই না!” ...তার ওজন মাস ঘুরে বছর ঘুরে ওয়েইং-মেসিনের
একটা ঘরও এদিক ওদিক হয়না, কিন্তু এদিকে যুক্তির মারপ্যাঁচে বাড়িসুদ্ধ সকলেরই প্রাণ
ওষ্ঠাগত!
একবার পার্কে কাকে জানি একটা মেরেছে, বাড়ি ফিরে শুনে বললাম – “বেঁধে রাখবো!” বলে
– “আমার বেবি হাতটা মেরেছে, তার জন্য আমার পুরো বডি-টাকে পানিশমেন্ট কেন দেবে?” সেও
আজ অনেক পুরনো কথা...
এসব তো গেলো যুক্তি-তক্ক নিয়ে। ভাবালুতায় আবার আরও এককাঠি বাড়া! হয়ত খুব তাড়াহুড়োয় আছি
– “তাড়াতাড়ি ওঠ, শীগগির জুতো পর করছি,” আর সে একটা জুতো পা দিয়ে গলাতে গলাতে – “আচ্ছা
মাম, ভাবো – আমাদের যদি দুটো পা না হয়ে পাঁচটা পা হতো? হিউম্যানদের কেন মাত্র দুটো পা হয়,
মাম?...” বলে এক এক করে পুরো অ্যানিমেল-কিংডমের পায়ের হিসেব নিয়ে খাতা খুলে বসলো!
কিছুদিন আগে ক্যুরিয়ার মারফৎ আমার একটা গিফট এসেছে। বলাই বাহুল্য, তারপরই শুরু
হয়ে গেলঃ “কদিন আগে ক্যুরিয়ার কাকু আমার জন্যেও একটা গিফট এনেছিল...”
সংবাদের পরবর্তী অংশটা এরকম –
-
“সেটার মধ্যে কি ছিল?”
-
“একটা রকেট।”
-
“ব্যাটারিতে চলে?”
-
“না না, বোটের মতন মেঘেদের ওপর ভেসে থাকে।”
-
“তারপর কি হল?”
-
“তারপর আমি ওই রকেটে চড়ে সূর্যের সাথে দেখা করতে গেলাম।”
-
“সূর্য কি বলল?”
-
“বলল, আমি সকালে উঠে হিউম্যান, আনিমেলস, প্লান্ট এদেরকে আলো
দি। আর রাত্তিরবেলা আমি সমুদ্রের নিচে গিয়ে ফিশদেরকে আলো দি।”
ওর এই বড় হওয়ার বিভিন্ন স্টেজে আমাদের দুজনের মধ্যে নানান ধরণের খেলা এবং কোড-ওয়ার্ডস
শুরু এবং অতীত হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন রোজ সন্ধ্যেবেলা যখন ও পার্ক থেকে ফিরত আর আমি
অফিস থেকে ফিরতাম, আমাদের দুজনের রোল এক্সচেঞ্জ হতো। প্রথমদিকে গেমটা ডিনার টাইম অবধি
গড়াতো, কিন্তু তাতে দেখলাম আমার বিশেষ খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না। ও আমি সেজে প্রায়দিনই
আমাকে অর্থাৎ ঘোতনকে বলতো – “কি হয়েছে ঘোতন, আর খেতে ইচ্ছে করছে না? ঠিক আছে, অনেক
খেয়েছ, আর খেতে হবেনা।” কিন্তু খেলা বন্ধ হওয়ার পরেও এই প্রিসিডেন্স টেনে এনে অনেকদিন
আমাকে নাকানিচোবানি খাইয়েছে।
“বোকা জামাই” খেলায় আমরা দুজনেই দুজনের প্রশ্নে “ক্যুউউ... ক্যুউউ...” করে উত্তর
দিতাম। তারপর ব্যাপারটা, যেমন হয়, ওই সুকুমার
রায়ের উকিলের গল্পের মতন টার্ন নিল। “খেতে আয়” – “ক্যুউ...” – “জামা ছাড়ো” – “ক্যুউ...”-
ইত্যাদি!
বেশ কিছুদিন মুরগিও হয়েছিলাম, তারপর যখন ব্যাপারটা সিরিয়াস দিকে যাচ্ছে তখন আমি
“এই খেলাটা আর খেলবোনা” বলে খুব বুদ্ধি-টুদ্ধি করে আরেকটা নতুন ব্যাপার আমদানি করলাম।
এই নতুন খেলাটা হোল রোজ একটা করে নতুন শব্দ ইন্ট্রোডিউস করা। “কমন সেন্স”, “ডিসিপ্লিন”,
“বিহেভিয়ার”, “ম্যানার”, “সেলফিস” ইত্যাদি পেরিয়ে যেইমাত্র “পেশেন্স” এ ঢুকেছি, অমনি
আবার খেলার মোড় গেলো ঘুরে! “তাড়াতাড়ি খাও”, “শীগগির ব্রাশ করো”-র উত্তরে হাত তুলে থামিয়ে
দিয়ে – “মাম, প্লিজ বি পেশেন্ট!”
এইভাবেই আমাদের এক-একটা খেলার উদ্ভাবন এবং পঞ্চত্ব প্রাপ্তি।
তারপর হল গিয়ে “অরগ্যান্স”! কেঁদে-কেটে ঘন্টাখানেক ধরে সাঙ্ঘাতিক ট্যানন্ট্রাম
থ্রো করে বাড়ি মাথায় করার পরবর্তী অনুশোচনা মুহূর্তে – “আমি করিনি মাম, আমার ব্রেনটা
করেছে। ব্রেনটাই আমার চোখ থেকে জল বের করে আর গলা থেকে চিৎকার বের করে তোমাকে জ্বালাতন
করছিলো। ব্রেনটাই আসলে দুষ্টু!”
এসব গুরু-মারা বিদ্যে দেখে-শুনে অস্থির হয়ে “আমি আর খেলবোনা” করে এবারে একটা নতুন
কন্সেপ্ট মার্কেটে নামানো গেলো। লিভিং – নন লিভিং, ডে-নাইট, প্ল্যানেটস, সিজনস, ডাইজেস্টিভ
সিস্টেম, এইসব নিয়ে কিছুদিন ধরে সাঙ্ঘাতিক বিজ্ঞান-চর্চা চলল কিছুদিন। শুধু একটা জায়গাতেই
খটকা – গাছ বস্তুটা না বলে কথা, না পারে হাঁটতে, স্রেফ সীড থেকে বেবী প্লান্ট হওয়ার
জোরে সগর্বে লিভিং-থিং হয়ে থাকবে, আর কোনকিছুই জীবনে প্রমাণ করার দায় নেই – এই ব্যাপারটায়
মাঝেমাঝেই একটু মৃদু আপত্তির স্বর ওঠে।
ক’মাস আগে আবার তেনার জন্মদিন নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিলো। এক এক করে ক্লাসের
সব বাচ্চাদের জন্মদিন হয়ে যাচ্ছে, আর ওর মার্চ আর কিছুতেই আসে না... তাও বা যা মার্চ
এলো, কিছুতেই আর টুয়েন্টি হচ্ছিলো না! ও ভালো করে না খেলে, সময়মতো না ঘুমোলে, টিফিন
ফিনি না করলে, যথেষ্ট স্ট্রং না হলে – সে আর্থ যতই সানের চারিদিকে বাঁই-বাঁই করে ঘুরুক
না কেন, টুয়েন্টির বাবার সাধ্য কি যে হয়!
আর তারপর, নয় নয় করে টুয়েন্টিটাও এসে পড়ল! জায়গা বুক হয়ে গেছে, বন্ধুদের কার্ড
বিলি করা হয়ে গেছে, মেনু ঠিক করাও, আর তারপর রিটার্ন-গিফট, “4” লেখা মোমবাতি, নানারকম
ডেকরেসান, বেলুন, বার্থডে পিনাটা, তার ভিতরকার মাল-মশলা, সব কেনা হয়ে গেছে, কিন্তু
অবশেষে সমস্যাটা এসে ঠেকেছে একটাই পয়েন্টে। কি না, কেকের থিম কি হবে? ডোরা না সিন্ডেরেলা,
নাকি ডরেমন, নাকি প্রিন্সেসের ক্যাসেল – এ সমস্যার কোনই নিষ্পত্তি করা যাচ্ছেনা! রোজ
ঘুমতে যাওয়ার সময় এক, পরেরদিন ঘুম থেকে উঠেই আরেক, তারপর স্কুল থেকে ফিরে আবার অন্যরকম।
“আমার বেবি ব্রেনটা না, কিছুতেই আমার কথা শোনেনা মাম! আমি যেই বলছি ডোরেমন, অমনি আমার
ব্রেনটা বলছে কি, সিন্ডেরেলা। আবার আমি যেই সিন্ডেরেলায় হ্যাঁ বলছি, আবার চেঞ্জ করে
দিচ্ছে। তুমি আমার ব্রেনকে বলো – ব্রেন, তুই আমার সোনার কথা শুনছিস না কেন?”
আর তারপর, সেই চার বছরের জন্মদিনও পেরিয়ে এলাম। ভাবা যায়! মাঝে মাঝে সত্যিই মনে
হয় – কিভাবে যে দিন, হপ্তা, মাস গুনতে গুনতে চার চারটে বছর ঘুরে গেলো, ঘুরে তাকানোর
অবকাশই পাইনি। সবসময় মনে হয় – এই তো সেদিন!!
কি জানি কি করে এতো তাড়াতাড়ি সময় চলে যাচ্ছে...
পরক্ষনেই আবার অন্য কথা ভাবি। ও যখন হয়নি, কি করতাম সারাদিন? কি নিয়ে ভাবতাম? কিরকম
ছিল, সবকিছু, আমার পৃথিবীটাই বা কেমন ছিল? কিসের টানে বাড়ি ফিরতাম? কি করতাম, ছুটির
দিনে?
ওর হওয়ার আগেকার সময়টা কেমন যেন মনে হয় গত জন্মের কথা। মনেই
পড়েনা...
No comments:
Post a Comment
Did you like it? Did you not? Please leave a comment...