Tuesday 22 November 2016

কে এই ভিকি রায়?

This post was first published in Rabibashoriyo, Anandabazar Patrika



২০০৮ সালে, গোটা বিশ্ব থেকে চার জন ফোটোগ্রাফারকে বাছা হয়েছিল, নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পুনর্নির্মাণের ফোটো-ডকুমেন্টেশনের জন্য। নির্বাচিত চার জনের দুজন আমেরিকা থেকে, এক জন হংকংয়ের। আর চতুর্থ জন, ভারত থেকে। ভারত থেকে? কই, শুনিনি তো!



টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি বেশ কিছু ক্ষণ হয়ে গেছে। তার পর ছেলেটা এল। হাতের পাঁচটা আঙুলে জল ভর্তি তিনটে কাঁচের গ্লাস নিপুণভাবে আঁকড়ে ধরে এনে রাখল আমাদের সামনে। ‘পানি লিজিয়ে।’ আটাশ বছর বয়স। মাঝারি হাইট, গায়ে ধূসর টি-শার্ট। আজ থেকে বছর পনেরো আগে ছেলেটা ঠিক এই ভাবেই জল দিত টেবিলে টেবিলে।

তখন কাস্টমার বলতে রিকশওয়ালা বা অটোচালক। নিউ দিল্লি স্টেশনের আজমেঢ়ি গেটের বাইরে পা রাখলেই সারি দিয়ে দোকান, পাইস হোটেল। তারই একটায় বাসন মাজত, ফাইফরমাশ খাটত। নাম জিজ্ঞেস করলে বলত, ভিকি রায়। অবশ্য এই ভদ্রসভ্য থাকা-খাওয়া সমেত চাকরির আগের বেশ ক’বছর কেটেছে প্ল্যাটফর্মে— কাগজ-কুড়োনো, ফাঁকা প্লাস্টিকের বোতলে জল ভরে বেচা, বা এ-দিক ও-দিক চুরি-চামারি। পুলিশের রুলের গুঁতো। গণপিটুনি।

কিন্তু অন্য রকম হওয়ার সুযোগ কি একেবারেই আসেনি? এসেছিল। তার জন্য পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েকটা বছর।

তখন বয়স প্রায় এগারো। বাবা পুরুলিয়ার এক টাউনে দরজির দোকানে মাস্টার। মাস গেলে মেরেকেটে পঞ্চাশ টাকা। তাই দিয়ে পুরো পরিবারের দু’বেলা ভাতই জোটে না। এই ছেলেকে তাই পাঠিয়ে দিল দাদু-দিদিমার কাছে। ক্লাস টেন অবধিও যদি পড়তে পারে! কিন্তু ঘর থেকে পয়সা চুরি করে এক-কাপড়ে বাড়ি থেকে পালাল ছেলে। পুরুলিয়ার তালডাঙা থেকে সোজা দিল্লি। বড় শহরে এক বার পৌঁছে গেলেই হিরো হওয়া যায়— যেমন সিনেমায় দেখায়! কিন্তু দিল্লি পৌঁছে স্টেশনে নেমে সব সাহস উবে চোখের জল! এত ভিড়, আর কেউ বাংলা বলে না। খাবে কী, শোবে কোথায়? ভয়ে গুটিসুটি মেরে প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় বসে কাঁপছে। দু’-চারজন দেখতে পেয়ে সোজা তুলে নিয়ে ভরতি করে দিয়ে এল পথশিশুদের জন্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘সালাম বালক ট্রাস্ট’-এ। কিন্তু সেখানেও গেরো! পুরো বন্দি হয়ে থাকতে হবে, হোম থেকে বেরনো যাবে না এক পা-ও! অগত্যা, তালা ভেঙে পাঁচিল টপকে আবার সোজা প্ল্যাটফর্ম।

ছেলে বন্দি থাকবে না নিজে, অথচ ক্যামেরায় বন্দি করে রাখতে চায় নিজের যত ফেলে আসা গল্প। ‘এত কিছুর মধ্যে হঠাৎ ক্যামেরাই কেন?’ জিজ্ঞেস করি আমি। কুতুব মিনারের পিছনে, মেহরৌলির দু’কামরার বাসস্থানে বসে আমরা, মুখোমুখি। সেখান থেকে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আবার পিছিয়ে যেতে হয় বেশ কয়েকটা বছর। ভিকি তখন ন্যাশনাল ওপেন স্কুলের ছাত্র। ধাবাতে জল দিচ্ছিল। এক দিন এক এনজিও-র ভলান্টিয়ার ধরে এনে আবার ভরে দিয়েছে সেই সালাম বালক-এই। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে ওরাই। আর এ বারে শুধু যে টিকে গেছে তাই নয়, টুকলি করে করে আগের ক্লাসগুলো টপকে পেরিয়েও গেছে মোটামুটি। কিন্তু গোলটা বাধল ক্লাস টেনে এসে। নম্বরের বহর দেখে স্কুলের শিক্ষকরা জবাব দিয়ে দিলেন, এর দ্বারা পড়াশোনা আর হবে না। সালাম বালক ট্রাস্ট কিন্তু হাল ছাড়ল না। যা হোক একটা ভোকেশনাল ট্রেনিং করুক তবে। সেই সময়ে কোডাকের একটা ক্যামেরা পাওয়া যেত, একদম বেসিক মডেল। প্লাস্টিকের বডি। দাম ৪৯৯, সঙ্গে দু’খানা রিল ফ্রি। সেই ক্যামেরা দিয়েই ভিকির ফোটোগ্রাফিতে প্রথম হাতেখড়ি।

কিন্তু, আঠেরো বছর বয়স হয়ে গেলে তো আর হোমে বসে খাওয়া যাবে না। তা ছাড়া দৈনন্দিন খরচাপাতিও আছে। ঠিক এই সময় খোঁজ পাওয়া গেল মোক্ষম একটা চাকরির। আনে মান বলে এক জন ফোটোগ্রাফার এক জন অ্যাসিস্ট্যান্ট খুঁজছেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে হবে ভারতের বিভিন্ন জায়গা। ছবি তোলার সময় লাইট ফিটিং করতে হবে, লেন্স পালটে দিতে হবে, ক্যামেরার দেখভাল করতে হবে। তার সঙ্গে ফোটোগ্রাফির আরও আনুষঙ্গিক ফরমায়েশ। মাস গেলে তিন হাজার টাকা মাইনে। ভিকি তো এক কথায় রাজি। কাজে ঢোকার পর, ভিকির আগ্রহ দেখে ভদ্রলোক ফি-মাসে তিনখানা করে ক্যামেরার রোল দেন ওকে, মাসিক উপরি হিসেবে। সালটা ২০০৪।

এ বারে বছর তিনেক এগিয়ে আসা যাক এক ধাক্কায়। ২০০৭, ভিকির প্রথম একক ফোটোগ্রাফি এগজিবিশন। আঠেরো বছরের নিচের বাচ্চাদের নিয়ে শুট। রাস্তার বাচ্চারা… ভোরে লোকের বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ, দুপুরে স্কুল আর বিকেলে ট্র্যাফিকে বেলুন নিয়ে সিগনালের প্রতীক্ষা। রাস্তায় খাওয়া, রাস্তায় ঘুম। ঠিক ভিকি নিজে যেমন ছিল!

আশ্চর্য ভাবে, ঠিক ভিকির মতই ভিকির ফোটোগুলোও কিন্তু বন্দি হতে নারাজ। দিল্লিতে শুরু হয়ে লন্ডনে তিন-তিন বার, ভিয়েতনাম থেকে সাউথ আফ্রিকা, দেশ দেশান্তর ঘুরে বেড়াতে লাগল ভিকির এগজিবিশন— ‘স্ট্রিট-ড্রিমস’।

পরের বছর নিউ ইয়র্কে গিয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের রিকন্সট্রাকশনের ছবি তুলবে ছ’মাস ধরে, আমাদের পুরুলিয়ার তালডাঙার ভিকি রায়। ২০০৯। বাকিংহাম প্যালেস। খোদ প্রিন্স এডওয়ার্ডের সঙ্গে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ। ‘কেমন লাগল?’ উত্তরে লাজুক হাসি, ‘কী বলব? সবাই দেখি বাইরে থেকে প্যালেসের ফোটো তুলছে। আর এ দিকে আমি, ভিতর থেকে বাইরের দিকে ক্যামেরা তাক করে আছি।’

তাক করে থাকেনি সাফল্যকে, কোনও দিনই। শুধু নিজের যা যা কিছু ইচ্ছে হয়েছে, যখন যখন ইচ্ছে হয়েছে, করেছে। সাহস করেছে। সাহস দিয়েছে নিজেকে।

২০১৩-য় বই বেরিয়েছে ভিকির: ‘হোম-স্ট্রিট-হোম’। এ বারের যাত্রা এনজিওর নাবালক আর সাবালকদের নিয়ে। হোমে কী ভাবে থাকে তারা, কী করে। নিজের জীবনকে আরও আর এক বার ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা, অন্য অন্য মুখের ছবি দিয়ে। ২০১৪, এমআইটি-তে মিডিয়া ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত। ২০১৬, এশিয়া থার্টি-আন্ডার-থার্টিতে নাম। ২০১৭-য় পরের বই বেরবে, কাজ চলছে। পুরুলিয়ায় মা’কে দোতলা বাড়ি করে দিয়েছে, ছবি দেখায় নিজের কম্পিউটারে। ভাই-বোনকেও পড়াচ্ছে কলেজে।

একটা প্রশ্ন এসেই যায়, তবু। ‘ভারত সরকারের পক্ষ থেকে কিছু…?’ আমার কথা মাঝপথেই থামিয়ে দেয় ভিকি। মাথা নেড়ে জানায়, না। তার পর হাসে, ক্যামেরার দিকে তাকায়। এ বারে ওর ছবি উঠছে যে।

No comments:

Post a Comment

Did you like it? Did you not? Please leave a comment...